আষাঢ়ে গল্প
আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখো?
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০১৭, ১৯:৩৯
গাড়ির কাঁচ তুলে আরামদায়ক শীতলতায় গা এলিয়ে বসে বাইরের অঝোর বৃষ্টি দেখছিলো মিতালী। এমন বর্ষার দিনে লো ভলিউমে বেজে চলা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে গলা মিলাতে ভালো লাগে ওর। একসময় ছায়ানটে গান শিখেছে। এখন আর সেসবের বালাই নেই যদিও, ব্যস্ত জীবন! তবুও বৃষ্টির দিনে সে গলা মেলায় মিতা হক, বন্যা বা ইন্দ্রানী সেনের সাথে। বৃষ্টি অপরূপ!
হঠাৎ গাড়ির কাঁচে টোকা পড়ে। তাকে ডাকছে মালতী। নাম দুটো শুনতে একরকম লাগলেও এক নয়। তেমনি তাদের জীবনটাও এক নয়। মিতালী একটি বেসরকারী ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর মালতী গার্মেন্টস এ কাজ করে। দুজনকেই "কর্মজীবী নারী" র ইনভার্টেড কমার মধ্যে ঢোকানো গেলেও, দুজনের জীবনে যোজন যোজন ফারাক। ফারাক তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতেও।
ড্রাইভারকে গাড়ির কাঁচ নামাতে বলে মিতালী। ভ্রু দু'টা সামান্য কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে? কাঁচে নক করছো কেন?"
মালতী একগাল হেসে বলে, "নাইমা আসেন আফা। আমরা অনেকক্ষণ আপনের জন্যি অপেক্ষা করতেসি।"
মিতালী মালতীর কথা বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে মালতীর ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মেয়েটার হাতে কোন ছাতা নেই দেখে বিরক্ত হয় মিতালী। এভাবে ভেজার কোন মানে হয়? একটা ছাতা বা রেইনকোট কি ম্যানেজ করতে পারতো না চাইলে?
মালতী আবার বলে ওঠে, "এতো অবাক হওনের কিসু নাই আফা। আমরা একটা খেলা খেলতেসি আইজ। ওই যে ফুটপাতের উপর দেখতেসেন দশ বারোজনের মতন মানুষ খাড়াইয়া আছে, হেরা সব খেলোয়াড়। আরো চাইর পাঁচজন আছে। আসতেসে, কাছাকাছি আইসা পড়ছে।"
মিতালী আরো বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, "মানে কি? কারা ওরা? আর আমাকেই বা ডাকছো কেন?"
মালতী হাসে। বলে, "আরে আফা, ঘাবড়াইয়েন না। কইলাম না, এইটা একটা খেলা।"
মিতালী: খেলা!!!
মালতী: হ আফা। আমরা আপনের মতো একজনের অপেক্ষায় ছিলাম। আসেন, আসেন। আরে, বাইর হনতো আফা। দেরী হইয়া যাইতেসে, আপনেরও, আমগোরও। সবারইতো কাজে যাওন লাগবো।
মিতালী কিছুটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। এরকম অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি। কি বলছে মেয়েটা তাও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না সে। তবুও, ওর ডাকে, অভিব্যক্তিতে কি যেনো একটা ছিলো, মিতালী উপেক্ষা করতে পারলো না। ভাবলো, দেখিই না কেন ডাকছে। মালতীর পিছু পিছু রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে দলটার সাথে গিয়ে দাঁড়ালো।
মালতী: আসেন আফা, পরিচয় করাইয়া দেই। এইযে এই ভাই একটা এনজিওতে কাজ করেন। লালমাটিয়া থাকেন। রোজ বাসে অফিসে যাতায়াত করেন। অল্প ইট্টু হাঁটতেও হয়।
এই আফাও এনজিওতে কাজ করেন, তয় সিএনজিতে যাতায়াত করেন। বাসে উনার কষ্ট হয়।
আর ইনি হইলেন জমির চাচা। রিক্সা চালান।
এইডা জুসনা। নদী ভাঙ্গনে মাথা গুজনের শেষ ভিটাটাও গেসে। দুইটা ছোড বাচ্চা আছে ওর।
এই ভাইয়ের নাম আনন্দ চাকমা। রাঙামাটিতে থাকে। পাহাড় ধ্বইসা বউ, বাচ্চা, মাপ মা সবাই মারা পড়সে একসাথে। হেয় তহন বাড়িত আসিলো না। তাই বাঁইচা গেসে।
এইডা সালেহা খালা। ভিক্ষা কইরা খায়। আগে মাইনসের বাসায় কাম করতো। অহন বয়স হইসেতো, শইল্যের গিঁডে গিঁডে ব্যাতা, আবার চোকখেও কম দ্যাহে।
এইভাবে একে একে মালতী ন্যাকরা হাতে গাড়ি মোছা এক কিশোর, ফুল বিক্রেতা কিশোরী, মাঝবয়সী সবজি বিক্রেতা, ব্যবসায়ী, ট্রাক চালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গৃহিনী, গৃহকর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, ডাক্তার, একজন সরকারী কর্মকর্তা, এমনকি একজন ভাসমান যৌনকর্মীর সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়।
পরিচয় পর্ব শেষে মালতী বলে, "আরো মাইনষের দরকার ছিলো। কিন্তু থাউক, আইজ এই কয়জনেই হইবো। আমরা একটা খেলা খেলুম আইজ। খুব সহজ খেলা। কিন্তু খুব দরকারী খেলা। খেলাটার নাম আমি যা দেহি, তুমি কি তা দ্যাহো? ওই যে টিভিতে দেহায় না? একটা ছুটো ছেলে তার দাদার সাথে খেলে, সেইরকম।
খালি এট্টু পার্থক্য আছে। চোখ মেইলা চাইলেই যেইটা দ্যাহা যায়, সেইটার কথা আমরা বলবো না। সেই দ্যাহাটার পিছনে যেইটা দ্যাহা গেলো না, যেইটা আর কেউ দ্যাকতে পাইলো না, সেইটার কথা বলবো। সেইটা আরেকজনরে দ্যাখানোর চেষ্টা করবো।
আমাগো আইজকার বিষয় হইলো "বৃষ্টি"। আপনেরা একে একে বইলা যাবেন এই বছর এই বৃষ্টিরে কে ক্যামনে দ্যাহেন? তারপর জানতে চাইবেন, বাকীরাও সেইটা দ্যাখতে পায় কিনা? ঠিকাছে?
খেলা শুরু হয়ে যায়। এনজিও কর্মী, রিক্সাচালক পার হয়ে নদীর পাড়ের জোৎস্নার গল্প চলতে থাকে। মিতালী বৃষ্টিকে কখনো ওদের মতো করে দেখেনি। বৃষ্টি সারাজীবন তার কাছে কাব্যের বিষয়, ভালো লাগার বিষয়। বৃষ্টির দিন মানেই আনমনে গান শোনা বা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা। কর্মজীবনে ঢুকে যাওয়ার পর তেমন বৃষ্টিবিলাস করার সুযোগ যদিও পায় না। তবুও বৃষ্টি তার ভালো লাগে। অথচ সেই একই বৃষ্টি কি নিদারুণ কষ্ট আর দুর্ভোগ হয়ে দেখা দিয়েছে ওদের জীবনে!!
কেন এই খেলা, কেইবা উদ্যোক্তা জানে না মিতালী। শুধু সম্মোহিতের মতো শুনতে থাকে ওদের জীবনের কথা আর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে নিজের গল্প বলার অপেক্ষায়।
লেখক: তরুণ কবি ও সাহিত্যিক