এক মায়ের কথা বলছি, ইতিহাসের পাতায় যার নাম নেই
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০১৭, ২১:৪৬
ঝিনুকের পাঁজরে বড় হয় যে রত্ন, তার নাম মুক্তা। রক্ত মাংসের একজন মুক্তা’র কথা বলবো আজ। এই মুক্তার জন্ম হয়েছিলো বাংলাদেশের প্রত্যান্ত একটি গ্রামে, সম্ভ্রান্ত সৌখিন বাবার প্রথম সন্তান। স্কুলেও পাঠিয়েছিলেন, যদিও সেই সময়ে এটা ছিলো একেবারেই সাধারণের চিন্তার বাইরে। সেই সময়টাতে মেয়েদের বিয়ে হতো অল্প বয়সেই বাবার ইচ্ছায়। পারিবারিক চাপ ও বাবার সম্মতিতে যখন বিয়ে হয় তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছিলেন, বিয়ে কি বিষয় সেটা ভালোভাবে বোঝার কথা নয় তার, তাই বিয়ের সম্মতি এখানে অবান্তর।
বিয়ে হয়েছিলো সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলের সাথে, তিনি তখন উচ্চ মাধ্যমিক এর ছাত্র। পরিবারের একমাত্র সন্তান তাই পিছুটান ছিলো কম। আর মানব সেবায় অধিক মনোযোগ থাকায় তিনি ছাত্র অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। গোটা বাংলাদেশ তখন ভীষণ উত্তাল, মুক্তির নেশায় উন্মুখ জাতি। ১৯৭০ এর নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে জন্ম হয় এই দম্পত্তির প্রথম সন্তান।
প্রথম সন্তান কন্যা, তার বয়স যখন মাত্র ছয় মাস, তখন তার বাবা স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ১৯৭১ সালে। ভারতের দেরাদূনে প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্তে ঘাঁটি বানিয়ে স্ত্রীর কাছে নিয়মিত নির্দেশনা পাঠাতেন। ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়েই স্বামীর নির্দেশনায় এলাকার তরুণ যুবাদের যুদ্ধে যাবার ব্যবস্থা করতেন স্ত্রী। একে তো অপরিণত বয়স, তার উপর প্রথম সন্তান কোলে, আর দেশে তখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান।
স্বামী যুদ্ধে, শ্বশুর শ্বাশুরি নিয়ে অনিশ্চয়তার জীবন তখন। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশীয় রাজাকার আর আল বদর এর সহায়তায় গোটা বাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এবার তিনি আশ্রয়টুকু হারিয়ে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও হাল ছেড়ে দেননি বরং তাকে পরিণত করে তোলে কঠিন সেই সময়।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয় অবশেষে। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে জন্ম হয় দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের। এভাবেই সংসারের মায়াজালে বন্দী হয়ে পড়েন মুক্তা। ১৯৭৫ সালের মুজিব হত্যার সময় তিনি তৃতীয় বারের মতো সন্তান সম্ভবা। জাতির পিতা হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্বামী রাজবন্দিত্ব বরণ করে আবার অনিশ্চয়তায় ফেলে দেন গোটা পরিবারকে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আবারো কন্যা শিশুর জন্মদান আর স্বামীর কারাবন্দী জীবন তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পারিপার্শ্বিকতা কতটা নিষ্ঠুর। তিন কন্যাকে বিয়ে কে কে করবে আর জেলে থাকা স্বামীর সম্পত্তি কে কিভাবে ভোগ করবে তার আলোচনা হচ্ছিলো একেবারে সামনেই, কোন লুকোছাপা নেই! ৯ মাস ১৩ দিন রাজবন্দী থেকে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাসায় আসলে ছোট্ট শিশুটি ফ্যলফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো অচেনা মানুষটির দিকে। জড়তা ছিলো তার, মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, এই লোকটা কে? বাবাকে চিনতে না পারা সেই শিশুটি পরবর্তীতেও ট্রমায় ভোগতেন।
আশির দশকের দ্বারপ্রান্তে জন্ম হয় সবেধন নীলমণি এক পুত্র সন্তানের। শুনেছি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ায় অনেকের মুখের হাসি নাকি বিষন্নতায় রূপ নিয়েছিলো। ছেলে হয়েছে এবার, সম্পত্তির শক্তিশালী ভাগীদার উপস্থিত, তাই তার মেয়েদের ভাগাভাগি করে বিয়ে করাটা আর কতিপয় লোলুপ হায়েনার হয়ে উঠলো না। কিন্তু তাই বলে ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। বলা হয় কারো ভালো না চাইলে তুমি হয় তাকে বিয়ে করিয়ে দাও নয়তো নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দাও। এবার হলো দুটোই, শ্বশুরকে দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েই ক্ষান্ত হয়নি স্বামীকেও নামানো হলো ভোটের ময়দানে, গোটা পরিবার টালমাটাল, এবার আর যায় কোথায় মুক্তা বেগম...
কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না, শ্বশুর সাহস দিলেন, পাড়ি দিলেন জেলা শহরে। শুরু হলো সত্যিকারের যুদ্ধ। শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলে (বেসরকারির চেয়ে তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই ভালো ছিলো বেশি) সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দিলেন। নিজেও পড়তেন সন্তানদের পড়াবেন বলে। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পারলেও এর পর আর পারেননি, ছেড়ে দিলেন সন্তানদের হাতে নিজেদের ভার। প্রাইভেট পড়ানো বেশ ব্যায়বহুল হওয়ায় তার ব্যবস্থা সব সময় করতে পারতেন না। তবে নজর রাখতেন আর বাসায় প্রাইভেট টিউটর বা কখনো ব্যাচে পড়াতে নিয়ে যেতেন নিজেই। শুধু পড়ালেখা নয় সন্তানদের বিতর্ক, স্কাউটিং, গার্লস গাইড সব করতে সমানভাবে উৎসাহ দিতেন।
গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে ও পুত্রবধূ, একটা সুবিধা তিনি পেয়েছিলেন। চাল, ডাল, আলু তরকারি বাড়ি থেকেই আসতো, তাই খরচ খুব বেশি না হলেও সন্তানদের পড়ালেখায় ব্যয় একেবারেই মন্দ নয়। ইতিমধ্যে পঞ্চম সন্তানের আগমন, কন্যা। এই যাত্রায় খুব অসুস্থ্ হয়ে পড়েন তিনি, সন্তান বা তার কারোরই বাঁচার কথা ছিলো না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ায় টিকে গেলেন দুজনেই।
একে একে ৫ সন্তানের জন্ম দিয়ে, তাদের মানুষ করতে গিয়ে নিজেকে সময় দিতে পারেননি। নিজে পড়ালেখা করতে না পারার যন্ত্রণা ছিলো, তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মাস্টার্স পাস না করিয়ে কোন মেয়েকে তিনি বিয়ে দেবেন না। সবাইকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। আর এটাও সত্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সামর্থ্য তার ছিলও না। স্বামী আজীবন রাজনীতি করেছেন, পরিবারের দিকে তাকানোর সময় তার কমই ছিলো। তবে তিনি একজন নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাই চাপটা ছিলো তার একারই। ইতিমধ্যেই শ্বশুর মৃত্যুবরণ করেন। বাবার অভাব বুঝতে দিতেন না যিনি। বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুটা ভেঙে পরেন। পুরো সংসার সামলিয়ে বাবাকেও সেবা করলেন একা হাতেই...
বাবা মায়ের প্রথম সন্তান, আট ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। শ্বশুর বাড়িতে একমাত্র পুত্রবধু, তাই দুই পরিবারকেই দেখতে হতো সমান তালে, সাথে পাঁচ সন্তানের লালন পালন। একটা রাষ্ট্র সামলানোর চেয়ে কম কিসের? ক্রমান্বয়ে সন্তানেরা বড় হতে লাগলো আর একেকজন স্কুল থেকে কলেজ আর কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, এ যেনো একটা ছুটে চলা দুরন্ত রেলগাড়ি...
স্বামী রাজনৈতিক নেতা, একজন তুমুল জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি, তাই রাজনীতি, সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি মুক্তা। নিজেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জড়িয়ে গেলেন সেই কবে, বুঝতেই পারেননি। শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্র তার বিচরণ, মানবতার ডাকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, একটি প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনের মহিলাদের অঙ্গসংগঠনের জেলা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, একটি সরকারি স্কুলের দুই দফায় সফল সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সর্বত্র।
২০০১ সালে স্বামীর অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হয়েছেন, মুষড়ে পড়েছেন, ভেঙ্গে যাননি। পাড়ি দিয়েছেন বন্ধুর পথ।
প্রথম সন্তান: কন্যা, পিএইচডি ডক্টর, অনার্স, মাস্টার্স জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
দ্বিতীয় সন্তান: কন্যা, এমফিল, বিএড, এলএলবি, অনার্স, মাস্টার্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে ঢাকা জজ কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত।
তৃতীয় সন্তান: কন্যা, অনার্স, মাস্টার্স জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
চতুর্থ সন্তান: পুত্র, এমবিএ, পিজিডি, এলএলবি, অনার্স, মাস্টার্স শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে একটি সরকারি ট্রাস্টে মানব সম্পদ উন্নয়ন সহঃ ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।
পঞ্চম সন্তান: কন্যা, অনার্স, মাস্টার্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহঃ পরিচালক হিসেবে কর্মরত।
তিনি কথা রেখেছেন, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার পাঁচ সন্তানকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর বিয়ে দিয়েছেন। সন্তানসম আরো ছয় ভাই বোনকেও বিয়ে দিয়েছেন। আজ তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তিনি আছেন সেই আগের মতোই। নাতি নাতনি নিয়ে তার সাজানো সংসার, এখনো ছুটে বেড়ান গ্রামে, শহরে এমনকি রাজধানীতে যে কোন প্রয়োজনে পাশে থাকেন সবারই। ছেলে মেয়ে মানুষ করে নাতি নাতনির লালন পালনও করছেন নিজের হাতেই।
মা একটি মাত্র অক্ষর, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট একটি সম্বোধন, কিন্তু এর বিশালতা এতো ব্যাপক কেন? এর ব্যাখ্যা দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। সন্তান জন্মদানে বাবা মা উভয়ের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক, কিন্তু মুখ্য ভূমিকা একজন মায়ের। সুদীর্ঘ নয় মাস গর্ভে ধারণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তান প্রসব করেন একজন মা। একটি মানব দেহে বেড়ে উঠে আরো একটি মানবদেহ। এটা ভীষণই এক জটিল প্রক্রিয়া। প্রসব বেদনা বুঝেন কেবল একজন মা। মানব শিশু বোধ করি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। পশু পাখিরা জন্মের পরই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মানব শিশু মা ছাড়া বেঁচে থাকার চেষ্টাও করতে পারে না।
হোসনেয়ারা ইদ্রিস মুক্তা, আমার মা। যিনি জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়েছেন গোটা পরিবারের জন্য। নিজের স্বাদ আহ্লাদকে মুঠোয় পুরে জ্বালিয়েছেন আলোর মশাল। ইতিহাসের কোন পাতায়, কোথাও হয়তো লিখা থাকবে না এই মহীয়সী নারীর বিজয় গাঁথা। কিন্তু আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় তুমি থাকবে মা...
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী