নারীদের সবুজ রাখার প্রত্যয়ে 'গ্রীন ওইম্যান'
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ০২:২০
সারা বিশ্বে বর্তমানে স্তন ক্যান্সার এর পরেই নারীদের দ্বিতীয় প্রাণঘাতী রোগ জরায়ু মুখ ক্যান্সার। কেবলমাত্র সচেতনতা দিয়েই যার ১০০ ভাগ নিরাময় সম্ভব। কিন্তু শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি হলেও কর্মজীবী দরিদ্র নারীরা এখনো জানেন না এই রোগের কারণ কিংবা প্রতিকার সম্পর্কে।
আর তাই এই সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সচেতন করতে, সবুজ রাখতে শুরু হয়েছে 'গ্রিন ওইম্যান' ক্যাম্পেইন, যার উদ্যোক্তা এক সাধারণ নারী ফারজানা সিরাজ শিলা।
চুয়াডাঙ্গার মেয়ে ফারজানা চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে স্থানীয় একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। চার বছরের ছেলেকে নিয়ে সিঙ্গেল মাদার ফারজানার জীবন চলছিল আর সব সাধারণ কর্মজীবী মধ্যবিত্ত নারীদের মতোই।
কিন্তু মাস তিনেক আগে হঠাতই পত্রিকার একটি খবরে চোখ আটকে যায় ফারজানার। জানতে পারেন জরায়ু মুখ ক্যান্সার এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। বরাবরই মানুষের জন্য কিছু করতে চাওয়া ফারজানা ঠিক করেন, এ নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য লক্ষ্য ঠিক করেন কর্মজীবী সুবিধাবঞ্চিত নারীদের।
কেন এমন চিন্তা? এই প্রশ্নের উত্তরে ফারজানা বলেন, "তাদের কষ্টে, ত্যাগে, পরিশ্রমে অর্থনীতির চাকা ঘুরে, কিন্তু তারা নিজেদের সম্পর্কেই সচেতন না। তারা এখনো পিরিয়ডে স্যানিটার ন্যাপকিন এর পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করে যা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করা বেশি প্রয়োজন"।
যেই কথা সেই কাজ। দেরী না করেই এই ব্যাপারে কাজ করার আগ্রহ জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন তিনি। সেখান থেকেই সাড়া দেন কয়েকজন।
ফারজানা বলেন, "ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পরে কয়েকজনের সাড়া পাই। তারা এ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখান। তারপর এর জন্য ফান্ড কালেকশন শুরু করি আমরা। শুরু হয় গ্রিন ওইম্যান এর কাজ"।
তবে চলার পথটা একেবারে সহজ ছিল না ফারজানার জন্য। পেরোতে হয়েছে অনেক প্রতিকূলতা, শুনতে হয়েছে নানা কটুক্তি। কিন্তু সেসব গায়ে না মেখে চার বছরের সন্তান আর ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়েই চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন ফারজানা।
ফারজানা বলেন, "আমাদের সমাজে এখনো পিরিয়ডকে একটা ট্যাবু হিসেবে ভাবা হয়। তাই এ নিয়ে কেউ সরাসরি কথা বলতে চায় না, সহযোগিতাও করতে চায় না। আমার এই উদ্যোগে আমার মা সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। কিন্তু মা ছাড়া পরিচিত অনেকেই এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। কয়েকজন নারী চিকিৎসকেরও কথা ছিল আমাদের সাথে থাকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর থাকেনি। আমার এক বন্ধু অনিন্দ্য শ্রাবণ আমাকে ফান্ড গড়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। এছাড়া হৃদয়, রবি, রিয়াজ, রাসিব, রবিন এরা প্রচুর সহায়তা করেছে। আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ"।
তবে সব বাধা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার গাজীপুরের এন কে নিটওয়্যার গার্মেন্টসে কর্মজীবী নারীদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেন ফারজানা, রবিন আর হৃদয়। এর মধ্যে রবিন অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করেছেন আর হৃদয় এবার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতে চান্স পেয়েছেন।
ফারজানা জানান, গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ প্রথমে অনুমতি দিতে চায়নি। পরে এক বন্ধুর মাধ্যমে ফোন করিয়ে অনুমতি নিতে হয়েছে। তবে পরে নারীরা খুব খোলামেলাই কথা বলেছেন, এমনকি পুরুষরাও।
ফারজানার ইচ্ছে, তার এই ক্যাম্পেইনকে দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে দেয়ার। সেই লক্ষ্যে আগামী মাসে রাজশাহী যাবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি। তবে নিজের এই ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দিতে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি।
ফারজানা বলেন, "গাজীপুরে প্যাড বিতরণের পর আমি এখন অনেক সাড়া পাচ্ছি। আমি চাই সবাই আমাকে সহযোগিতা করুক। সবার সহযোগিতা ছাড়া আমার একার পক্ষে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। অর্থ অথবা প্যাড, যে যেভাবে সম্ভব আমাকে সহযোগিতা করতে পারেন। ০১৭৬৫১৮৩৬৫২ এটা গ্রিন ওইম্যান এর বিকাশ নম্বর। চাইলে যে কেউ আমাদের এই পথচলায় সঙ্গী হতে পারেন"।
গ্রিন ওইম্যান এর পথচলায় কি প্রত্যাশা সবার কাছে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারজানা বলেন, "নারীদের জরায়ু মুখ ক্যান্সার এবং ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন ইচ্ছে করলেই এড়ানো যায়। কাপড়ের পরিবর্তে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহার করলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব অনেকাংশে। নারী আজ সব জয় করে ফেলছে এটাও পারবে নিশ্চিত। আমি চাই পিরিয়ড, নারীস্বাস্থ্য এটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হোক। নারী নিজের প্রতি যত্নশীল হোক, সুস্থ থাকুক মনে এবং দেহে, তবেই সে সবাইকে সুস্থ রাখতে পারবে। নারী সদা সবুজ থাক"।