‘আত্মের অন্বেষণ’: হতাশার দুয়ারে একচিলতে প্রত্যাশা

প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৮, ০০:১৬

শিল্প-সাহিত্যে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কোনো শিল্পকর্ম, রচনা বা বইয়ের রিভিউ বা সমালোচনা পত্রিকায় ছাপা হলে সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মটি সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ জন্মায়। আর একজন পাঠকের মতামতের উপর ভিত্তি করেই লেখকের লেখনীর গুরুত্ব।

আমি সাধারণত কবিতার বই পড়ি না, কবিতা খুব একটা বুঝিও না! সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আমায় বেশ টানে। তাদের কবিতায় আমি ‘আমাকে’ খুঁজে বেড়াই। সেই খুঁজে বেড়ানোকে কেন্দ্র করেই এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যই শাহেরীন আরাফাত লিখিত ‘আত্মের অন্বেষণ’ শীর্ষক কবিতার বইটি পড়া শুরু করি- অনেকটা দোটানা মনোভাব নিয়ে। কেননা এ সময়ের কবিদের ‘কবিতা’ কি আমায় টানবে, বা তাদের কবিতাকে কি আমি টানতে পারবো!

সেই দোটানা মনোভাব আমাকে আমার চিন্তার ভাঙন ঘটায়। এই কবিতার বইটি আমাকে টেনেছে, সেখানেই আমি ‘আমাকে’ খুঁজে পেয়েছি।

‘আত্মের অন্বেষণ’ বলতে আমরা যা বুঝি- প্রাণীদেহে ব্যাপৃত চৈতন্যময় সত্তাপ্রাণ, আত্মপরীক্ষা, নিজের দোষ-গুণ বিচার, আত্মসম্পর্কে জ্ঞানলাভের প্রয়াস- মূলত নিজ স্বরূপের অন্বেষণ। কবির এই নাম নির্ধারণের সঙ্গে কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহের যোগসূত্র অসাধারণ। একুশে বইমেলায় উৎস পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ খুবই আকর্ষণীয়, যা বইটির মান আরো বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন।

‘আত্মের অন্বেষণ’ কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৬টি কবিতা রয়েছে। প্রেম, দ্রোহ, বিদ্রোহ, সংগ্রাম, রাজনীতি, অর্থনীতি- সবকিছুই কবিতার ছকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

‘আত্মের অন্বেষণ’ শীর্ষক কবিতা দিয়েই বইটির সূচিপত্র শুরু হয়েছে। যার শেষে রয়েছে ‘শিরোনামহীন’ শীর্ষক কবিতাগুচ্ছ। এ কবিতাগুচ্ছে রয়েছে ২৯টি কবিতা। যার শেষ কবিতাটির কথা, যেন আমারও কথা-

‘আমি কবি নই, একদমই তা নয়

লিখি নিজের জন্য, নিজেকে প্রকাশের জন্য

তবুও অপ্রকাশিত আমি...’

কবি এভাবেই কবিতার বইটি সাজিয়েছেন যে, বইটি পড়ে হতাশার দুয়ারে যেন একচিলতে প্রত্যাশা পাই! বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে এ বইটি যে, কবিদের চিন্তাজগত এখনও বিকিয়ে যায়নি। মানুষ এখনও চিন্তা করে মানুষের মুক্তির জন্য।

‘আত্মের অন্বেষণ’-এর ৭ নম্বর কবিতাটি নতুন ‘আমি’কে চিনতে, তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ‘আমিত্ব’ শীর্ষক কবিতাটি তুলে ধরছি-

‘তীব্র আমিত্ব-

হ্যাঁ, তীব্র আমিত্ব থেকেই আসে

ভালোবাসা সমাজের প্রতি

মানুষের প্রতি

শ্রেণীর প্রতি

‘আমি’র সত্তাকে উপলব্ধি না করলে

কি করে সে ভালোবাসবে অপর সত্তাকে!

‘আমি’র বিকাশেই যে জড়িত অপর

অথবা

অপরের বিকাশে ‘আমি’

আমিত্ব ভালোবাসতে শেখায়

পরমকে নয়, সত্তাকে,

এই ভালোবাসা নয় আবদ্ধ

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পোশাকে

বিচ্ছিন্নতায় নয়,

তার গন্তব্য সামষ্টিকতায়’

এই মনোমুগ্ধকর কবিতাটি আমায় শিখিয়েছে ‘আমিত্ব’ আর ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’র পার্থক্য। আমি কবির এই দৃষ্টিভঙ্গির কাছে ঋণ স্বীকার করছি। কবি আমায় নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই- কখনও মাত্র একটা বাক্যই মানুষকে অনেক পরিবর্তন করতে পারে, অনেক সময় বইয়ের পাহাড় বা অস্ত্রও পারে না! চিন্তাই সেখানে বড় হাতিয়ার।

কবি তুলে ধরেছেন- ফ্যাসিবাদ, পাহাড়ের কান্না, সশস্ত্র সংগ্রাম, ভোগবাদ, পুরুষতন্ত্র-এর মতো বিষয়। কবিতা-বোদ্ধা না হওয়ার কারণে তার লেখনীর অনেক ধাঁচই হয়তো আমি সেভাবে ধরতে পারিনি। তা আমার পাঠকসত্তার সীমাবদ্ধতা হয়তো। তবে এটুকু মনে হয়েছে, ‘আত্মের অন্বেষণ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রগতিশীল পাঠকদের পড়া খুব জরুরি।

সবশেষে বলতে চাই, এখানে আমি এ বই নিয়ে রিভিউ, সমালোচনা, পর্যালোচনা, মূল্যায়ন- কোনোটাই করিনি। হয়তো তা করার যোগ্যতাও সামান্য। এখানে আমি শুধু বইটি পড়ার পর আমার নিজস্ব কিছু অনুভূতিই কাঁচা-হাতে তুলে ধরেছি। যদি এতে পাঠকদের কোনো কাজে আসে, তাই লেখা। বইটি পাঠকসমাজের মধ্যে প্রচার হোক, সেই প্রত্যাশা করাটা কী বেশি হবে!

ভালো থেকো ‘আত্মের অন্বেষণ’।

ভালো রেখোও!

লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত