আমার স্বামী নিরপরাধ: হাসনাত করিমের স্ত্রী
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৮:২৩
গত বছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটা জঙ্গি হামলা ও সেখানে থাকা অন্তত ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় নিজের স্বামী আবুল হাসনাত রেজাউল করিমকে আবারো নিরপরাধ দাবি করেছেন স্ত্রী শারমিন পারভীন, যিনি ঘটনার দিন দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সেখানে ছিলেন।
শারমিনের ভাষ্য, ওই হামলার সঙ্গে তার ‘নিরপরাধ’ স্বামীর সংশ্লিষ্টতার কোন তথ্য কারও জবানবন্দিতে উঠে আসেনি। তারপরও তাকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে।
গুলশান হামলার এক বছরের মাথায় এক সাক্ষাৎকারে শারমিন বলেন, “অন্য যারা জিম্মি ছিল, তারা আস্তে আস্তে রিকভারি করছে, কিন্তু আমাদের জন্য পরিস্থিতি তেমন না। গত এক বছর ধরে আমরা ট্রমাটিক সিচুয়েশনের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। মানুষ একটা ঘটনা ঘটলে রিকভারি করার চেষ্টা করে, ভুলে যেতে চেষ্টা করে; কিন্তু আমাদের ফ্যামিলি সেই সুযোগটা পায়নি।”
হাসনাতের স্ত্রী শারমিন পারভীন বলেন, "আমাদের তের বছর বয়সী মেয়ে শেফা করিমের জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় হলি আর্টিজানে গিয়েছিলাম আমরা। আমার হাজবেন্ড বলে কেবল আমি বলছি তা না, অন্য যারা জিম্মি ছিল, তারাও জবানবন্দিতে বলেছে, সবাই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বলেছে, কেউ কিন্তু একবারও বলেনি যে হাসনাত করিম এসবের মধ্যে জড়িত ছিল। যারা ওই রকম অ্যাটাক করবে তারাতো অ্যাক্টিং করবে না। তারা জিম্মি হিসাবে অ্যাক্টিং করে সারারাত মাথা নিচু করে টেবিলে বসে থাকবে না। যারা জিম্মি অবস্থায় ছিল তারাই বলতে পারে হাসনাতের অ্যাক্টিভিটিজ তখন কেমন ছিল। অন্যদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন আমার হাজবেন্ডের অ্যাক্টিভিটিজ কী ছিল ওই রাতে।”
ঘটনার রাতের বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “এতোগুলা মানুষকে সমানে মারছে, ফায়ারিং করছে, ডেডবডিগুলোকেও সমানে কুপিয়ে যাচ্ছে। মৃত জানার পরও সমানে কোপাচ্ছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। ওই যে সাউন্ডটা... ওই রাতটা আসলে…। ফিরে আসার পর আমি এক সপ্তাহ ঘুমাতে পারি নাই; বাচ্চাদের তাহলে কী অবস্থা বোঝেন!”
শারমিন বলেন, "জঙ্গিরা জিম্মিদের কোনো আঘাত করেনি। কিন্তু টেবিলে মাথা নিচু করে বসে থাকতে বলেছিল, আর মাঝে মাঝে হুমকি দিচ্ছিল যে মাথা তুললেই শেষ করে দেবে। কিন্তু মাথাতো উঁচু করতে হয়েছে। সারারাত টেবিলের উপর মাথা নিচু করে থাকাতো স্বাভাবিকভাবেই পেইনফুল। রোজা রেখে রাতে আমরা ডিনারও করিনি, খাবার অর্ডার দেওয়ারও সময় পাইনি, সেই অবস্থায় ঘটনার শুরু হল। না খাওয়া অবস্থায় ওইভাবে মুভ না করে থাকাটা খুবই ডিফিকাল্ট ছিল।”
ঘটনার কয়েকটি ছবিতে জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে হলি আর্টিজানের ছাদে দেখা যায় হাসনাত করিম ও তাহমিদকে। এ বিষয়ে শারমিনের ভাষ্য, অস্ত্রধারী জঙ্গিরা হাসনাতকে যা করতে বলেছে, প্রাণ বাঁচাতেই সে তা করেছে।
শারমিন বলেন, “যখন আমার স্বামীকে ছাদে নিয়ে গেল, তখন আমরা মনে করছিলাম, ছাদে নিয়ে শুট করবে, আর হয়তো দেখতে পাব না। আমার মাথা টেবিলে নিচু করা ছিল... যখন পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল, তখনও ভাবছিলাম, হয়তো আর দেখতে পাব না। ওরা ছাদে নিয়ে গেল আমার হাজবেন্ডকে, তাহমিদকে। কিছুক্ষণ কনভারসেশন করল... আমাদের যেটা ভয় ছিল, পুলিশ এসে অ্যাটাক করলে তো আমরা কেউ বাঁচব না। আসামাত্র হয়ত ব্র্যাশফায়ার শুরু হবে... কে অ্যাটাকার আর কে হোস্টেজ তখন হয়ত বুঝতে পারবে না।”
শারমিন বলছেন, ভোরে ছাদ থেকে ঘুরে আসার আধা ঘণ্টা পর জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জঙ্গিরা। সবাইকে একে একে বেরিয়ে যেতে বলে তারা। তার আগে হাসনাত করিমকে দিয়েই হলি আর্টিজানের গেইট খোলায় তারা।
হাসনাত এখন কাশিমপুর কারাগারে আছেন জানিয়ে তার স্ত্রী বলেন, “আমরা মাসে দুইবার দেখা করার সুযোগ পাই। এর বাইরে যোগাযোগের উপায় নাই।”
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জন নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অপারেশন থান্ডারবোল্টের ঠিক আগে সেখান থেকে উদ্ধার হয় ১৩ জন।
পুলিশের হিসাবে, সকালের এই ১৩ জনসহ হামলার পর বিদেশি নাগরিক ও হোটেল কর্মচারীসহ মোট ৩২ জন জীবিত উদ্ধার পান।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিম এবং কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খান বাসায় ফেরেননি বলে তাদের পরিবার জানায়।
এর মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলার পরদিন ভোরে পাশের ভবন থেকে ধারণ করা একটি ভিডিও প্রকাশ পেলে হাসনাতের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার সন্দেহ জোরালো হয়ে ওঠে। ওই ভিডিওতে অস্ত্র হাতে তাহমিদকেও দেখা গিয়েছিল এক জঙ্গির সঙ্গে। নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরিরের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে হাসনাতকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় অব্যাহতি দিয়েছিল বলে গণমাধ্যমের খবর। হালি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযানে যে পাঁচ হামলাকারী নিহত হন, তাদের মধ্যে নিবরাস ইসলামও ঢাকার এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
এরপর গতবছর ৩ অগাস্ট তাদের দুজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। এর মধ্যে তাহমিদকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলেও হাসনাতকে গুলশান হামলার মূল মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল পুলিশকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ থেকে আদালতের রায়ে খালাস পান তাহমিদ। তিনি মুক্তি পেলেও গুলশান হামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেপ্তার হাসনাত কারাগারেই আছেন।
তদন্তে হাসনাতের বিষয়ে কী পাওয়া গেছে জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “হাসনাত করিম এখনো এই মামলার সন্দেহভাজন আসামি। সে কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এই মামলায় সে বর্তমানে জেলে আছে। তদন্ত শেষে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে আমরা জানাব।”