‘গণপরিবহনে ২৩% নারী যৌন হয়রানির শিকার হন’
প্রকাশ : ২০ মে ২০১৭, ২৩:১৪
অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে ঢাকা শহরের ৫৮ শতাংশ নারী গণপরিবহনে উঠতে পারেন না। ৫৬ শতাংশ নারী পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার কারণে ঘরের বাইরে যেতে চান না। ২৩% নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। আর ২৬ শতাংশ নারী বলছেন, নিরাপত্তার অভাবে তাদের পরিবার ঘরের বাইরে যেতে দেয় না।
২০ মে (শনিবার) ‘নারী সংবেদনশীল নগর-পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। বিশ্ব নিরাপদ শহর দিবস উপলক্ষে গুলশান কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্থপতি ইকবাল হাবিব, একশনএইড বাংলাদেশের নির্বাহী বোর্ডের সদস্য ডা. খলিলুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আক্তার মাহমুদ।
২০১৬ সালের এপ্রিল ও মে মাসে নগরের বিভিন্ন বয়সী ও পেশার ২০০ জন নারীর মধ্যে গবেষণাটি চালানো হয়।
গবেষণাটি বলছে, ৯৩ দশমিক ৫ ভাগ নারী নানা কারণে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেন না। এমনকি পুরুষ সঙ্গী ছাড়া তাঁরা একা এসব টয়লেট ব্যবহার নিরাপদ মনে করেন না। ২২ দশমিক ৫ ভাগ নারী বাসের স্টাফ এবং সহযাত্রী দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ২০০ জন নারীর অনেকেই ফুটপাতকে হাঁটার উপযোগীও মনে করেন না। ৭২ শতাংশ নারী বলেন, ফুটপাতগুলো নির্মাণসামগ্রী, হকার ও দোকানদারদের দখলে। ৬১ দশমিক ৫ ভাগ নারী মনে করেন, ফুটপাতগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত না হওয়ার কারণে চলাচলে সমস্যা হয়।
গবেষণাটি বলছে, ৮৭ শতাংশ নারী পার্ক ও উদ্যান সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলেছেন। রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতার সমস্যাসহ পার্ককে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের স্থান মনে করেন অনেক নারী। যাও আছে সেগুলো নিরাপদ নয় বলে মনে করেন ৪২ ভাগ নারী।
অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, নিরাপত্তার অভাবে নারীরা তাদের চলাফেরা সীমিত করে ফেলে। যার প্রভাব পড়ে নারীদের কর্মক্ষেত্রে। তারা তাদের অধিকার ও দাবী থেকে বঞ্চিত হন। অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতির স্বীকার হন।
তিনি বলেন, একজন পুরুষের তুলনায় শহরের নারীর জীবনযাপনের বাস্তবতা ভিন্ন এবং অনেক জটিল। এ সমস্যা সমাধানে নগর-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
কিশোরীদের জন্য খেলার মাঠ থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, নারীর উন্নয়ন কেবল ভাবনার মধ্যে রাখলে হবে না। তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নগরের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করতে হবে।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সম্মানসূচক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এম খলিলুর রহমান বলেন, ভালো ও পর্যাপ্ত টয়লেট-সুবিধা না থাকায় নারীদের ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন বেশি হয়।
অনুষ্ঠানে গবেষণার প্রেক্ষপট ও মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রনয়ন, প্রকল্প ডিজাইন, বাস্তবায়নসহ বেশীরভাগ কাজে নারীদের সংখ্যা কম থাকায় নারী ব্যবহার বান্ধব নগর কাঠামো তৈরি হয় না। এ কারণে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, শপিংমল, পরিবহণ ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক, উম্মুক্তস্থানসহ সকল গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।
দেশের রাজনীতিবিদেরা কতটুকু হাঁটেন অথবা অথবা তাঁদের সন্তানেরা বাসে-রিকশায় চলাচল করে কি না, প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এ জন্য নগরে বৈষম্য বাড়ছে। নগরটি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকা শহরের রাস্তা, বাস স্ট্যান্ড, ফুটপাত, মার্কেট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন নারীর উপর জরিপ করে গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়। গবেষণায় কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- যে কোন প্রকল্প প্রণয়নের ধারণাপত্র থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নারী সংবেদনশীলতার প্রতিফলন থাকতে হবে। নারী বান্ধব শহর এবং কমিউনিটি-নেইবারহুড উন্নয়নের পরিকল্পনা নীতি তৈরির সময় নারী সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে নারী সংবেদনশীল কৌশলনীতি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে। মূলধারার পরিবহন পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনায় নারী সংবেদনশীল নীতি গ্রহণ করা। নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী রাস্তা, ওয়েটিং স্টেশন, টার্মিনাল ও স্টপেজ নির্মাণ করা। পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠে অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিহত করা।
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একটি মুক্ত আলোচনার পর্ব অনুষ্ঠিত হয়; যেখানে গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্নসহ নানা বিষয়ে মত দেন।