হাওরে মহাদুর্যোগ

ধর্মপাশায় বিপাকে হাঁস খামারীরা

প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৪৯

জাগরণীয়া ডেস্ক

একের পর এক বিপর্যয় হাওরবাসীকে অতিষ্ট করে তুলেছে। ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর হাওরের মাছই ছিল কারও কারও জীবন জীবিকার একমাত্র অনুপ্রেরণা। কিছুদিন যেতে না যেতেই মাছের মড়ক হাওরবাসীর সেই অনুপ্রেরণাকে নষ্ট করে দিয়ে নতুন বিপর্যয় হাতছানি দিতে থাকে। এখানেই শেষ নয়। যেহেতু হাওর তলিয়ে গেছে সেহেতু হাঁসের খামারীরা স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের খামারকে আরো প্রসারিত করবেন। কারণ হাওরে হাঁসের খাদ্যের কোনো অভাব হবে না। কিন্তু হাওরাঞ্চলের কোথাও কোথায়ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁস মরে যাওয়ার খবর খামারীদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছে। হাওরের দূষিত পানি ও আর দুর্গন্ধে হাঁস আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে পারে এই ভয়ে খামারীরা তাঁদের হাঁস কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

২২ এপ্রিল (শনিবার) দুপুরে কথা হয় হাঁস খামারী জামালের সাথে। তিনি জানালেন, তাঁর খামারে হাঁস ছিল ১৫০০টি। খাবার সংকট ও রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁস মরতে পারে এমন ভয়ে ৭০০টি হাঁস কয়েকদিন আগে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি এই হাঁসগুলো প্রতিটি ৪০০ টাকা দরে কিনেছিলেন। কিন্তু এখন বিক্রি করেছেন প্রতিটি ২০০ টাকা দরে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো হাঁসের মৃত্যু ঘটেনি।

ধর্মপাশা উপজেলার চামরদানি ইউনিয়নের সাড়ারকোনা গ্রামের বাসিন্দা এই খামারী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আওরে (হাওর) আঁস (হাঁস) মরতাছে হুইন্যা কেউ কিনতো চায় না। এইবার আমরার ফসল নাই। এহন আবার আঁসের উপরে গজব চলতাছে। যে মাইরে হরছি (পড়েছি) হেই মাইর থাইক্যা কয়েক বৎসরেও উডন যাইতো না।’

ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের চকিয়াচাপুর গ্রামের হাঁস খামারী মানিক মিয়া জানান, তাঁর ১৪০০টি হাঁস আছে। রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর হাঁস মরে যাচ্ছে। তিনি জরুরি ভিত্তিতে হাঁসের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ধান না থাহাতে এখন যে অবস্থা শুরু অইছে তাতে আঁস (হাঁস) বেইচ্চা দেওন ছাড়া উপায় নাই। মানুষেরইতো খাওন নাই।’

মোহনগঞ্জ উপজেলার তেতুলিয়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. তাহের মিয়ার রাজহাঁসের খামার রয়েছে। তাঁর ৫০০টি হাঁসের মধ্যে গত কয়েকদিনে ৩৫টি হাঁস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তাঁর বেঁচে থাকা হাঁসগুলোর জন্য প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইমণ ধানের প্রয়োজন। হাওরঞ্চালের কৃষক এবার ধান তুলতে না পারায় প্রতি মণ ৯০০ টাকা দরে ধান কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম স্থানীয় কুরশিমুল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। রফিকুল ইসলাম বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি হাঁসের খামার দিয়েছিলেন। ১৫০০টি হাঁসের মধ্যে ৫০০ হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করেছে। 

রফিকুল ইসলামের মা ছালেমা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে রফিকুল এনজিও থেকে ঋণ তুলে খামার গড়ে তুলেছিল কিন্তু হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে। তাই বেশি দাম দিয়ে ধান কিনে হাঁসের খাবার দিতে গিয়ে খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছি। ঠিকমত খাবার দিতে না পারলে ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’

একই গ্রামের আরেক খামারী হাঁসের ছোট বাচ্চা সংগ্রহ করে তা বড় করে বিক্রি করেন। কিন্তু এবার তিনি হাঁসের দুই হাজার বাচ্চা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। খাদ্য সংকটের কারনে হাঁসের বাচ্চাগুলোর দাম কম হলেও বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পন করছেন তিনি। 

বিশষজ্ঞদের মতে, অগভীর জলাশয়ে পচনশীল উদ্ভিদ বা মৃত প্রাণি জমা হলে ঐ জলাশয়ের পানির নীচের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে কীট-পতঙ্গ, শামুক, ঝিনুক ও মাছ ইত্যাদি মারা যায়। এসব জীব পচে জীবাণু তৈরি করে রোগ সৃষ্টি করে থাকে। হাঁস সাধারণত কাদামাটিতে খুটে খাবার খাওয়ার ফলে এই জীবাণু হাঁসের অন্ত্রে বিরাজ করে। ফলে হাঁস বটুলিজম রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ রোগ ওয়েস্টার্ন ডাক সিকনেস নামেও পরিচিত। ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট নিউরোটকসিন এ রোগের প্রধান কারণ। তবে এসব হাঁস বটুলিজম রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বুঝার কোনো উপায় নেই বলে জানালেন, বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয় (বাকৃবি) এর মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। 

ধর্মপাশা উপজেলার স্থানীয় প্রশিক্ষিত ভ্যাটেরিনারি চিকিৎসক লিটন দাস বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে খামারীরা হাঁসের চিকিৎসার জন্য বেশি আসছে। হাওরের দূষিত পানিতে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ হাঁস কলেরা, ফাউল কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে হাঁস মরে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে।’

ধর্মপাশা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, ‘খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারনে হাওরাঞ্চলের হাঁস কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সকল হাঁস খামারীরা আমাদের কাছে পরামর্শের জন্য যারা আসছেন তাদের সবাইকে হাঁসগুলো আবদ্ধ জায়গা, যেমন পুকুর ও বা ডোবায় রাখার জন্য বলা হচ্ছে।’ 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এর মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরে বিভিন্ন রোগে হাঁস মারা যেত পারে। তবে হাওরে বর্তমানে যে কারনে হাঁস মারা যাচ্ছে সেটাকে সরাসরি বটুলিজম বলা যাবে না। বটুলিজমের কোনো প্রতিষেধক নেই। যেখানে হাঁস মারা যাচ্ছে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই বলা যাবে ঠিক কেন হাঁস মরছে। এখন বিপদমুক্ত রাখতে আক্রান্তসহ সকল হাঁসকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া উচিত।’

প্রতিবেদন এনামুল হক এনি, ধর্মপাশা
সূত্র: দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত