নারী অধিকার সংক্রান্ত আইন, নীতিমালা ও আমাদের সংবিধান
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০১৭, ০৯:৫৮
নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মানবাধিকারের সব বিষয়গুলোই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অধিকন্তু নারীদের জন্য আছে আরো কিছু অধিকার যা একান্তভাবে নারীকে তার নিজস্ব মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায়। নারী অধিকার এমন একটি বিষয় যা সব বয়সের নারীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে, এ অধিকারের মধ্যে কিছু অধিকার সর্বজনীন ও কিছু অধিকার বিশেষায়িত। বিশেষায়িত অধিকারগুলো আইন, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান, জাতি ও রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ অধিকারগুলো সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রীতি দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে। তবে, যেভাবেই দেখিনা কেনো, নারীর এ অধিকারগুলো নারীকে তার আপন সত্তায় উদ্ভাসিত করে।
মানবাধিকারের যে শাখাটি নিয়ে সারাবিশ্বেই তোলপাড় তা হলো নারী অধিকার। নারী অধিকার নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আইন রয়েছে, রয়েছে আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ। জাতীয় গণ্ডির ভিতরে প্রায় প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব আইন আছে। সেই আইন কখনো সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত আবার কোথাও বিশেষ আইন দ্বারা স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার রক্ষায় গৃহিত হয়েছে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ সনদ স্বাক্ষরও করে। এটি একটি আন্তর্জাতিক দলিল ও প্রতিশ্রুতি।
আইনানুযায়ীই রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ডে নারীর ক্ষমতায়ন এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে প্রয়োজন সেই অধিকারকে রক্ষা করা।
বাংলাদেশের সংবিধান ও নারী অধিকার
বাংলাদেশের সংবিধান নারীর অধিকারের প্রতি এক অসাধারণ স্বীকৃতি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনও সুযোগ নেই।
– সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে, ‘ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’।
– সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’।
– সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।
– সংবিধানের ২৮ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী- পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না’।
– সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’।
– সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে’।
– সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।- – সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৪৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
অর্থাৎ সংবিধানের প্রতি পূর্ণরূপে বিশ্বস্ত থাকলে বাংলাদেশের কোনও ক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনও রকম বৈষম্য থাকার বা বৈষম্যমূলক কোনও আচরণ করার সুযোগ নেই। এমনকি, নারী উন্নয়নের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় কোনও উদ্যোগ নিলেও তা সংবিধান সমর্থন করে, কিন্তু এসব আইন থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক নারী বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন নারীরা।
নারী অধিকার সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন
নারী নির্যাতন বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আশির দশকের শুরুর দিকে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা দমনে ১৯৮৩ সালে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নারী নির্যাতন বন্ধে এ আইন খুব বেশি কার্যকর হচ্ছিল না। ফলে আরো কঠোর আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন পাস করা হয়। এ আইন পাসের পর নারী নির্যাতন কিছুটা বন্ধ হয়। পরে আইনটি বাতিলক্রমে ২০০০ সালে নতুন করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটিকে আরো শক্তিশালী করতে ২০০৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া এসিড-সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ প্রভৃতি আইন রয়েছে। এ ছাড়া মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ, দেনমোহর, তালাক, অভিভাবকত্ব ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রীকরণ) আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের ৫২নং আইন), মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ আইনে নারীর বিভিন্ন অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সামাজিকভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবিধান এবং আইনে থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই।
এ ছাড়া দেশে প্রথমবার জাতীয় নারী নীতি আইন প্রণয়ন করা হয় ১৯৯৭ সালে, এরপর ২০০৪ ও ২০০৮ সালে তা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে পুনরায় নারী নীতি প্রণয়ন করা হয়।
নারী নীতি পরিচিতি
বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ নারী। নারী উন্নয়ন তাই জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। সকল ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য। মূলত এ নীতির মূল সূত্র হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যেসব অধিকার ও সুযোগ রয়েছে এবং জাতিসংঘে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Women, 1979 (CEDAW 1979), একে International Bill of Rights of Women ও বলা হয়ে থাকে তারই আলোকে সরকারের নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
২০১১-এর জাতীয় নারী নীতির বিষয়বস্তু: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি প্রায় ১৪ বছর পুরোনো আর (CEDAW)-এর জন্ম থেকে বর্তমানে এটি ৩২ বছর পুরানো। বর্তমানে অনুমোদিত ২৪ পৃষ্ঠার এ নীতিটি মোট ৩ টি ভাগে ৪৯ টি ধারায় বিভক্ত।
এর কয়েকটি হলো: উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নারী, নারীর প্রতি বৈষম্য, বিলোপ সাধনের সনদ। নারী ও আইন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী মানবসম্পদ, নারী-রাজনীতি ও প্রশাসন, জাতীয় নারী উন্নয়নের লক্ষ্য, নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নারীর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন দূরীকরণ, শিক্ষা ও প্রশাসনে নারী, ক্রিড়া ও সংস্কৃতিতে নারী, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, নারী-উন্নয়নে এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনের সাথে সহযোগিতা, নারীর ক্ষমতায়নেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রভৃতি।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি ভাগের কিছু নীতিমালা সমূহ তুলে ধরা হয়েছে-
দ্বিতীয় ভাগ
ধারা-১৬. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর লক্ষ্যসমূহ নিম্নরূপ: ১৬.১- বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ১৬.২- রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৬.৩- নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইনগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ১৬.৪- নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ১৬.৫- আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর পূর্ণ ও সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৬.৬- নারীকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলা।১৬.৭- নারী সমাজকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১৬.৮- নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা। ১৬.৯- সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা। ১৬.১০- নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন দূর করা। ১৬.১১- নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা। ১৬.১২- রাজনীতি, প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া এবং পারিবারিক জীবনের সর্বত্র নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ১৬.১৩- নারীর স্বার্থের অনুকূল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আমদানী করা এবং নারীর স্বার্থ বিরোধী প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। ১৬.১৪- নারীর সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৬.১৫- নারীর জন্য উপযুক্ত আশ্রয় এবং গৃহায়ন ব্যবস্থায় নারীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা। ১৬.১৬- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সশস্ত্র সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। ১৬.১৭- প্রতিবন্ধী নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নারীর অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা। ১৬.১৮- বিধবা, বয়স্ক, অভিভাবকহীন, স্বামী পরিত্যাক্তা, অবিবাহিত ও সন্তানহীন নারীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। ১৬.১৯- গণ মাধ্যমে নারী ও কন্যা শিশুর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা সহ জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা। ১৬.২০- মেধাবী ও প্রতিভাময়ী নারীর সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করা। ১৬.২১- নারী উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়ক সেবা প্রদান করা। ১৬.২২- নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা।
ধারা- ১৭. নারীর মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: ১৭.১- মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার সকল ক্ষেত্রে, যেমন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ যে সমঅধিকারী, তার স্বীকৃতি স্বরূপ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা। ১৭.২- নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১৭.৩- নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করা। ১৭.৪- বিদ্যমান সকল বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করা এবং আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন বা কমিটিতে নারী আইনজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৭.৫- স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা। ১৭.৬- বৈষম্যমূলক কোন আইন প্রণয়ন না করা বা বৈষম্যমূলক কোন সামাজিক প্রথার উন্মেষ ঘটতে না দেয়া। ১৭.৭- গুণগত শিক্ষার সকল পর্যায়ে, চাকুরিতে, কারিগরি প্রশিক্ষণে, সমপারিতোষিকের ক্ষেত্রে, কর্মরত অবস্থায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা। ১৭.৮- মানবাধিকার ও নারী বিষয়ক আইন সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান ও সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করা। ১৭.৯- পিতা ও মাতা উভয়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচিতির ব্যবস্থা করা, যেমন জন্মনিবন্ধীকরণ, সকল সনদপত্র, ভোটার তালিকা, ফরম, চাকরির আবেদনপত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদিতে ব্যক্তির নাম প্রদানের সময় পিতা ও মাতার নাম উল্লেখ করা।
ধারা-১৮. কন্যা শিশুর উন্নয়নঃ ১৮.১- বাল্য বিবাহ, কন্যা শিশু ধর্ষণ, নিপীড়ন, পাচারের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা। ১৮.২- কন্যা শিশুর চাহিদা যেমন, খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন আচরণ করা ও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা। ১৮.৩- কন্যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যথাযথ বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। ১৮.৪ কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীকরণ এবং পরিবারসহ সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা। ১৮.৫- কন্যা শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা। ১৮.৬- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন রাস্তাঘাটে কন্যা শিশুরা যেন কোনরূপ যৌন হয়রানি, পর্নোগ্রাফী, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ১৮.৭- কন্যা শিশুর জন্য নিরাপদ ও মানসম্পন্ন বিনোদন, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুবিধা নিশ্চিত করা। ১৮.৮- প্রতিবন্ধী কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন দূরীকরণ এবং সকল ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ধারা- ১৯. নারীর প্রতি সকল নির্যাতন দূরীকরণঃ ১৯.১- পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা দূর করা। ১৯.২- নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রচলিত আইন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশোধন এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা।১৯.৩- নির্যাতনের শিকার নারীকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা। ১৯.৪- নারী পাচার বন্ধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা। ১৯.৫- নারীর প্রতি নির্যাতন দূরীকরণ এবং এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ বাহিনীর সর্বস্তরে বর্ধিতহারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৯.৬- বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে নারীর অধিকার সংশ্লিষ্ট আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া ও জেন্ডার সংবেদনশীল করা। ১৯.৭- নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতন ও পাচার সম্পর্কীয় অপরাধের বিচার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার পদ্ধতি সহজতর করা।১৯.৮- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভাগীয় শহরে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) ও মহিলা সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা এবং ওসিসির কার্যক্রম জেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নির্যাতনের শিকার নারীদের মানসিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মহিলা সংস্থা ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।১৯.৯- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সমাজের সকল পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিবর্তনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা। ১৯.১০- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গণমাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। ১৯.১১- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষ ও যুবকদেরকে সম্পৃক্ত করা।
ধারা- ২৫. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নঃ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা- ২৫.১- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা। ২৫.২- উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।
ধারা- ২৬. নারীর কর্মসংস্থানঃ ২৬.১- নারী শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্যে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা। ২৬.২- চাকরি ক্ষেত্রে নারীর বর্ধিত নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রবেশ পর্যায়সহ সকল ক্ষেত্রে কোটা বৃদ্ধি এবং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ২৬.৩- সকল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুসৃত কোটা ও কর্মসংস্থান নীতির আওতায় চাকরি ক্ষেত্রে নারীকে সকল প্রকার সমসুযোগ প্রদানের জন্য উদ্ধুদ্ধ করা। ২৬.৪- নারী উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করা।২৬.৫- নারীর বর্ধিত হারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, অবস্থান ও অগ্রসরমানতা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা। ২৬.৬- নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল আইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।
ধারা- ৩২. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নঃ ৩২.১- রাজনীতিতে অধিকহারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যে প্রচার মাধ্যমসহ রাজনৈতিক দলসমূহকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করা। ৩২.২- নারীর রাজনৈতিক অধিকার অর্জন ও প্রয়োগ এবং এর সুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। ৩২.৩- রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। ৩২.৪- নির্বাচনে অধিকহারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুপ্রাণিত করা। ৩২.৫- নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন করা এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ভোটার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। ৩২.৬- রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নারী সংগঠনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রচার অভিযান গ্রহণ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করা। ৩২.৭- জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা ও বর্ধিত সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। ৩২.৮- স্থানীয় সরকার পদ্ধতির সকল পর্যায়ে বর্ধিত সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। ৩২.৯- সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার উচ্চ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী নিয়োগ করা।
ধারা- ৩৩. নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়নঃ ৩৩.১- প্রশাসনিক কাঠামোর উচ্চ পর্যায়ে নারীর জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক এবং পার্শ্ব প্রবেশের (Lateral Entry) ব্যবস্থা করা। ৩৩.২- প্রশাসনিক, নীতি নির্ধারনী ও সাংবিধানিক পদে অধিকহারে নারীদের নিয়োগ প্রদান করা।৩৩.৩- জাতিসংঘের বিভিন্ন শাখা ও অঙ্গ সংগঠনে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি বা প্রার্থী হিসেবে নারীকে নিয়োগ/ মনোনয়ন দেয়া। ৩৩.৪- নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রবেশপর্যায় সহ সকল পর্যায়ে, গেজেটেড ও নন-গেজেটেড পদে কোটা বৃদ্ধি করা। ৩৩.৫- সকল ক্ষেত্রে নারীর জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ সাপেক্ষে কোটা পদ্ধতি চালু রাখা। ৩৩.৬- কোটার একই পদ্ধতি স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য করা এবং বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এই নীতি অনুসরণের জন্য উৎসাহিত করা। ৩৩.৭- জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সুপারিশ অনুসারে সরকারের নীতি নির্ধারণী পদসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল স্তরে নারীর সম ও পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শতকরা ৩০ ভাগ পদে নারী নিয়োগের উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
তৃতীয় ভাগ
ধারা- ৪৯. নারীর ক্ষমতায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাঃ নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আর্থিক ও কারিগরী সহযোগিতা এবং অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা হবে।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় করণীয় ও আইনের বাস্তবায়নঃ নারীর অধিকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশে অনেক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু আইনগুলো বাস্তবায়নের হার কম থাকায় যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, এসিড-সন্ত্রাসের শিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সম্পত্তিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন নারীরা। নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত, পারিবারিক আদালত এবং ফৌজদারি আদালতে নারী সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বছরের পর বছর এসব মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় নারীরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়েনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এলেও উচ্চপর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছেন।বিশ্বের অনেক দেশেই সংবিধানের ভিত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনে তারা সংবিধানকে বা বিদ্যমান আইন সংশোধন করেছে।
তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার। রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় নারী তথা জনগণের ক্ষমতায়ন।
সূত্র: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ