'নারীর প্রতি সহিংসতায় নতুন মাত্রা সাইবার ক্রাইম'
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৭, ২৩:৫৭
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে 'অনলাইন নিউজ পোর্টালে নারীর উপস্থাপন বিষয়ক সমীক্ষা' করা হয়। সমীক্ষাটি করার জন্য নির্ধারিত সময় সীমা ছিল ১৫ দিন (৭-২১ আগস্ট) ২০১৬। সমীক্ষায় অনলাইন পত্রিকাগুলোর বিশ্লেষিত ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে হোম পেইজ, বিজ্ঞাপণ, ছবিসহ বিশেষ পাতার সংবাদ। যেসব পোর্টালে নারী পাতা আছে সেগুলোকেও সমীক্ষার আওতায় আনা হয়।
এই সমীক্ষার ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী যে সহিংসতার শিকার হচ্ছে তাতে প্রযুক্তির ক্ষতিকর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। সাইবার ক্রাইম নারীর প্রতি সহিংসতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার গণমাধ্যমের চেহারাও পরিবর্তন করেছে। গণমাধ্যমে সৃষ্ট একটি নতুন ক্ষেত্র হচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আর অনলাইন নিউজ পোর্টালে নারীর উপর কিরূপ প্রভাব ফেলে তা দেখার জন্যই এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে। সমীক্ষাটি লক্ষ্য ছিল অনলাইন নিউজ পোর্টালে নারীর উপস্থাপন বিশ্লেষণ করা; অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর নারী বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ; অনলাইন নিউজ পোর্টালে বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন; নারীর প্রতি সহিংসতা ও মাত্রা বাড়ার ক্ষেত্রে অনলাইন নিউজ পোর্টালের কোন প্রভাব আছে কিনা তা যাচাই করা'।
বিবৃতিতে বলা হয়, সমীক্ষার জন্য মূলধারা থেকে ৬টি ইংরেজি এবং বাংলা পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল বাছাই করা হয়, শুধুমাত্র অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে ১১ টি নেয়া হয়। এর মধ্যে বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোরকে নেয়া হয়েছে পাইয়োনিয়ার নিউজ পোর্টাল হিসেবে। নিউজ পোর্টালগুলোর ধরণের ক্ষেত্রেও কিছু ভিন্নতা রয়েছে যে কারণে প্রতিনিধিত্বকারী যেন হয় সেই দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। মোট ১৭ টি নিউজ পোর্টালে নারীর উপস্থাপন বিশ্লেষন করা হয়েছে। সমীক্ষটি চলাকালে শীর্ষ নিউজ এবং বাংলা মেইল টুয়েন্টিফোর ডট কম এই দুইটি নিউজ পোর্টাল বন্ধ হয়ে যায়।
যে পত্রিকাগুলোর নিউজ পোর্টাল পর্যালোচনা করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে - মূলধারার বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা ৬টি। ১.দৈনিক প্রথম আলো, ২.দৈনিক ইত্তেফাক, ৩.দৈনিক মানবজমিন, ৪.ডেইলিস্টার, ৫.নিউ এইজ এবং ৬.ঢাকা ট্রিবিউন। অনলাইন পোর্টালগুলোর ১১ টি হচ্ছে: ১.বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২.বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৩.শীর্ষ নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৪.জাগো নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৫.বাংলা মেইল টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৬.দ্যা রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৭.রাইজিং বিডি ডটকম, ৮.ঢাকা টাইমস ডটকম, ৯.ক্রাইম এক্সপ্রেস/অপরাধ চোখ, ১০.বাংলা ট্রিবিউন ডটকম, ১১.ব্রেকিং নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।
মহিলা পরিষদ জানায়, পর্যালোচনায় দেখা যায় মূলধারার সংবাদপত্রেরে পোর্টালগুলোতে নারী বিষয়ক সংবাদ; ছবি ও বিজ্ঞাপন অনলাইন নিউজ পোর্টাল সমূহের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ছিল। অন্যদিকে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সমূহে নারীর নেতিবাচক উপস্থিতি অধিক লক্ষ করা গেছে। বিশেষত বিনোদন এবং লাইফস্টাইলে নারীর নেতিবাচক ও বিকৃতভাবে উপস্থিতি অন্য পেইজগুলোর চেয়ে বেশি ছিল। শিরোনাম এবং ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন লক্ষ করা গেছে।
হোম পেইজ অর্থাৎ নিউজ পোর্টালের প্রথম পাতায় ১৫ দিনে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত মাত্র ৬/৭ টি সংবাদ একাধিক পোর্টালে পাওয়া গেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'নারীর প্রতি যে গতানুগতিক অধঃস্তন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তার প্রতিফলন অনলাইন পোর্টালগুলোতেও দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক ধরনের পর্ন ছবির ব্যবহার। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ শিরোনাম এবং ভিতরের সংবাদের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায় শিরোনামগুলোতে এমন শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয় যা নারীর প্রতি অধস্তন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। যেখানে অনেক পাঠককে বিশেষভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা থাকে। কিন্তু ভিতরের লেখা এত নেতিবাচক হয় না'।
এছাড়া কোন কোন অনলাইন পোর্টালে বিশেষ করে স্বনামধন্য মূলধারার কিছু নিউজ পোর্টাল ও অনলাইন নিউজ পোর্টাগুলোতেও গুগল অ্যাড নামে বিজ্ঞাপন থাকে। সেখানে কিছু সময়ের জন্যে যে বিজ্ঞাপণগুলো আসে তাতে নারীর প্রতি বিকৃত নেতিবাচক উপস্থাপন দেখা যায়। এছাড়া জনপ্রিয় পোর্টালগুলোতে 'ইউ মে লাইক' এর মত কিছু শিরোনাম থাকে, যেখানে স্পন্সর কনটেন্ট পাওয়া যায় যেখান থেকে পর্নের স্পন্সর সাইটে চলে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
এই ব্যাপারে অনলাইন পত্রিকার সাথে যুক্ত কয়েকজন সাংবাদিক বলেন, "আমাদের দেশে অসংখ্য অনলাইন অশ্লীল নিউজ প্রকাশে কোনোরকম বিধি নিষেধ মানে না। তারা অবাধে নিউজের নামে রীতিমত পর্ন প্রকাশ করে চলেছে। অনেকে আবার এসব নিউজ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে। বেলা পরিবর্তনের সাথে সাথে পোর্টালগুলোর নিউজও পরিবর্তন হয়। দিনের বেলা পোর্টালগুলোতে একটা বা দুটো পর্ন নিউজ পাওয়া যায়। অন্যদিকে একই পোর্টালগুলোতে পর্ন নিউজ প্রকাশের ক্ষেত্রে গভীর রাতকে বেছে নেয়া হয়। ফলে দিনের বেলায় সেসব নিউজগুলো নিউজ সাইটে থাকে না"।
এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাড. জেয়াদ-আল-মালুম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড.অমিত দাশগুপ্ত ও একটি ইংরেজি পত্রিকার অনলাইন নিউজ পোর্টালের দায়িত্বে নিয়োজিত তানভির সুফির সাক্ষাৎকার নেয়া হয় যেখানে তারা অনলাইনে পর্নের প্রচারের ফলে সমাজে এর প্রভাব এবং অনলাইন পোর্টালগুলো কিভাবে পর্নের প্রচারে কাজ করে থাকে সে বিষয়ে কথা বলেন।
মহিলা পরিষদের এই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান এই সহিংসতার পেছনে পর্নোগ্রাফি যে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির চিত্র দেখেই তা অনুধাবন করা যায়। কারণ পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতায় বিভিন্ন বয়সের পুরুষেরা অনেক সময় এই ঘৃণ্য অপরাধ করে থাকে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির উপর অনেক বেশি নির্ভর। স্মার্ট ফোনের বদৌলতে তারা যেকোন মুহূর্তে চাইলেই সংবাদ পড়তে পারে। আর এই ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। যেগুলোর অধিকাংশই পর্ন সাইটে ঢোকার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। যার ফলে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে"।
এই সমীক্ষার প্রেক্ষিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ সমূহ হল,
১। অনলাইন পোর্টাল সমূহ পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন
২। অনলাইন পোর্টালগুলোর জেন্ডার সংবেদনশীল নীতিমালা থাকা এবং এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থাকা দরকার
৩। অনলাইন সংবাদ মাধমে যৌন ও সহিংসতা মূলক তথ্য প্রদান বন্ধের লক্ষে মনিটরিং সেল গঠন এবং নিয়মিত এর কার্যক্রম পর্যালোচনা দরকার
৪। নিউজ পোর্টালগুলোর আয় বৃদ্ধির লক্ষে অনলাইনে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন
৫। মহামান্য হাই কোর্টের রায় প্রণীত যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি অফিসে গঠন করা দরকার
৬। ওয়েজ বোর্ডে যারা আছেন তাদেরকেও এই ইস্যুগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে যাতে নিউজ পোর্টালগুলো এই ধরনের সংবাদ, ছবি বা শিরোনাম, বিজ্ঞাপন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়
৭। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে তরুণী ও অভিভাবকদের সতর্ক থাকার লক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে
৮। মোবাইল বা কম্পিউটারে পর্নের ব্যবহার বন্ধের জন্য সরকারের সাথে লবি করতে হবে
৯। প্রযুক্তিগত অপরাধ/অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে
১০। এই বিষয়ে মহিলা পরিষদসহ অন্যান্য নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা দরকার।