অভিজিৎ রায়কে স্মরণ
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৮:১৩
বাংলাদেশী-মার্কিন প্রকৌশলী, লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন ১২ সেপ্টেম্বর। তিনি বাংলাদেশের মুক্ত চিন্তার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত ব্লগসাইট ‘মুক্তমনা’ বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার প্রসারে সবচেয়ে শক্তিশালী প্লাটফর্ম। তিনি বাংলাদেশে সরকার সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী কিন্তু তিনি তাঁর স্ব-প্রতিষ্ঠিত সাইট মুক্তমনায় লেখালেখির জন্য বেশি পরিচিতি পান ব্লগার হিসেবে।
১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞান লেখক ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে জন্মদিনের দুদিন আগে ১০ সেপ্টেম্বর এলিফ্যান্ট রোডে ‘ফিল্ম উইদআইট ফিল্ম’ এর কার্যালয় তাকে স্মরণ করেন তাঁর মতাদর্শের ক’জন অ্যাক্টিভিস্ট। এদিন জঙ্গিবাদ বিরোধী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও অভিজিৎ রায়ের কর্মময় জীবনের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
রাকিবুল হাসান নির্মিত ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। প্রামাণ্যচিত্রে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করেই উঠে আসে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কিভাবে বিস্তার লাভ করেছে স্বাধীনতা ও মানবসভ্যতার অগ্রগতি বিরোধী জঙ্গী সম্প্রদায়।
প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী শেষে আলোচনায় নির্মাতা রাকিবুল হাসান বলেন, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথকে রুদ্ধ করার যে চক্রান্ত করেছিলো মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের সেই চক্রান্তের স্বীকার আমাকেও হতে হয়েছে। অভিজিৎ রায়ের উপর এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকালীন আমাকেও মৌলবাদী হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে, কিন্তু আমি কি ভীত? নিজের আদর্শ থেকে সরে এসেছি? না । আমি ভীত নই, আমি আমার আদর্শ থেকে বিচ্যুত নই। আমি অভিজিৎ রায়ের মানবিক আদর্শের বার্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছি এই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। আমার মনে হয় এভাবেই আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাবো চিন্তার স্বাধীনতার এই আন্দোলনকে। এখানেই মুক্তচিন্তার জয়। কলমের কাছে এভাবেই বারবার হেরে যাবে ধর্মান্ধের চাপাতি’।
সাংবাদিক সাকিল অরণ্য বলেন, অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যারা বাংলাদেশকে আদিম অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে চায় তাদের ইচ্ছে কখনোই পূরণ হবেনা। কারন ব্যক্তিকে হত্যা করা মানেই ব্যক্তির আদর্শকে হত্যা করা নয়। জীবিত অভিজিৎ এর চেয়ে মৃত অভিজিৎ অনেক বেশি শক্তিশালী। অভিজিৎ রায়ের মানবতাবাদী আদর্শ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার দায় আমাদেরকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে’।
চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহাদাত রাসএল বলেন, একজন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ এর মৃত্যুর জন্য আমি আতঙ্কিত নই, আমি আতঙ্কিত এইসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে ও এইসব ধর্মান্ধ খুনিদেরকে বিচার করতে সরকারের গড়িমসি দেখে। আমি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। কারন আমি জানি অভিজিৎদের আদর্শকে খুন করা যায়না। আমার সন্তান হবে পরবর্তী প্রজন্মের অভিজিৎ রায়’।
অ্যাক্টিভিস্ট সংগীতা ঘোষ বলেন, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পরে দীর্ঘ সময় পাড় হলেও সরকার এই হত্যাকাণ্ডের কোন সুরাহা করতে পারেনি যা থেকে আমরা সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান। আমরা চাইনা এভাবে কোন মানুষকে হত্যা করা হোক। কারন যে মতাদর্শ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে সেই মতাদর্শ কোন ধর্ম হতে পারেনা’।
অভিজিৎ রায়ের দর্শন ও তার বিজ্ঞানময় আদর্শ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার শপথ নেয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়।
প্রসঙ্গত, অভিজিৎ রায়ের পিতা একুশে পুরস্কার বিজয়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. অজয় রায়। অভিজিৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্র কৌশলে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্ত এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাড়ার আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখান থেকে আটলান্টা, জর্জিয়ায় যান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসা না পর্যন্ত সেখানে একজন প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করতেন।
তিনি ২০০১ সালের দিকে সমমনা কয়েকজন লেখকদের নিয়ে মুক্তমনা নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। তিনি এই সাইটের আটজন নিয়ন্ত্রককের একজন ছিলেন। এই ওয়েবসাইটটি দ্য ববস সেরা অনলাইন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০০৭ সালে মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রেক্ষিতে মুক্তমনা ওয়েবসাইট শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক অর্জন করে। এই ওয়েবসাইটে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর ঠিক পূর্বে তাঁকে পাঠানো হত্যার হুমকিগুলি প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ, বাস্তববাদ, সন্দেহবাদ ও যৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস নামক তাঁর দুটি বাংলা বই পাঠক মহলে বহুমুখী সমালোচনা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রকাশিত বইতে ও ব্লগে ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমালোচনা করার কারনে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় ইসলামিস্ট টেররিস্টরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে।
ড. অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫) মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭) স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮) সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০) অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১) বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২) ভালবাসা কারে কয় (২০১২) শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪) বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪) ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫)।