নিজ উঠোনে চিরনিদ্রায় শায়িত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ২০:১৩
কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে নিজ বাড়ির উঠোনে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি। মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির মরদেহে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
১ ডিসেম্বর (শনিবার) বিকেল ৩টার দিকে রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে তাঁর জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নিজ বাড়ি রাজিবপুরের কাচারীপাড়া গ্রামের আঙ্গিনায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবিকে।
এ সময় কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. রুহুল আমিন, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন, কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম, কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম, রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জাকির হোসেন, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, চিলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শওকত আলী সরকার, রাজিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিউল আলম, রৌমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী, রাজিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান, রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায়, সাবেক কুড়িগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলাম টুকু, রাজিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আব্দুল হাই সরকার, রৌমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আব্দুল কাদের সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মহান এই মুক্তিযোদ্ধা ১ ডিসেম্বর (শনিবার) রাত দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান।
বীর প্রতীক তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, ডায়েবেটিস আর শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। বিশেষ করে শীত শুরু হওয়ায় তার ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে তিনি নিজে নিজে হাঁটা চলা ভালোভাবে করতে পারছিলেন না বলে জানান স্বজনরা।
বীর প্রতীক তারামন বিবি কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে ১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তার স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তখন ১১নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান।
একদিন দুপুরে খাবারের সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট নিয়ে তাদের দিকে আসছে। তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখ যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। অনেকবার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান।
যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালিন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। পরে একই সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী এবং রাজিবপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সবুর ফারুকীর সহায়তায় তাকে খুঁজে বের করেন।নারী সংগঠনগুলো তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার তুলে দেন।