চলে গেলেন একাত্তরের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বীর প্রতীক তারামন বিবি
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:১৩
ছবি: ইউসুফ আলমগীর, কুড়িগ্রাম
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন তিনি। সহযোদ্ধাদের জন্য রান্না করেছেন, নিজেদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সময়মত সেসব নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়া আর দক্ষ গুপ্তচরের মত পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহ করা অসম সাহসী বীর তারামন বিবি আর নেই। মহান এই মুক্তিযোদ্ধা ১ ডিসেম্বর (শনিবার) রাত দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান।
বীর প্রতীক তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, ডায়েবেটিস আর শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। বিশেষ করে শীত শুরু হওয়ায় তার ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে তিনি নিজে নিজে হাঁটা চলা ভালোভাবে করতে পারছিলেন না বলে জানান স্বজনরা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১ ডিসেম্বর (শনিবার) রাত একটার দিকে তারামন বিবি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজিবপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন তাঁর বাড়িতে আসেন। রাত দেড়টার দিকে তিনি তারামন বিবিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে নভেম্বরে তাকে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। অবশ্য কদিন পরেই তিনি ফিরে যান নিজ বাড়িতে।
এদিকে ১ ডিসেম্বর (শনিবার) দুপুর ২টায় তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে দাফন করা হবে। গার্ড অফ অর্নারে অংশ নেবেন কুড়িগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, পুলিশ সুপার মেহেদুল করিমসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বীর প্রতীক তারামন বিবি কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে ১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তার স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তখন ১১নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান।
একদিন দুপুরে খাবারের সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট নিয়ে তাদের দিকে আসছে। তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখ যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। অনেকবার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান।
যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালিন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। পরে একই সালে ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন। নারী সংগঠনগুলো তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালিন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার তুলে দেন।