জাতীয় শোক দিবস
শোকাবহ ১৫ আগস্ট
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৪:৪৯
‘আমার সবচেয়ে বড় গুণ, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আর আমার দোষ, তাদের আমি বেশি ভালোবাসি।’ দেশ আর মানুষের প্রতি যার ছিল এই অগাধ ভালোবাসা; যার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পেয়েছিলো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার জন্য এই অঞ্চলে ঘটা সকল বিদ্রোহের সম্মিলিত চেতনা, সাহস আর দৃঢ়তা। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের অন্যতম মহান এই নেতাকে স্বপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা।
বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য আজ শুধুই অশ্রু ঝরার দিন; প্রিয়জন হারানোর ব্যথা বুকে বাজার দিন। আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী। এই দিনে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার স্থপতিকে, বাংলাদেশিরা হারিয়েছেন তাদের জাতির পিতাকে, বাঙালি হারিয়েছে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতিবিদকে। এ দুঃখ সইবার নয়, এ দুঃখ ভোলার নয়।
১৯৭৫ সালের এই কালো দিনটিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে শহীদ হন ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে। কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের চক্রান্ত এবং সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তার প্রিয় সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। তবে প্রবাসে থাকায় সেদিন প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
মধ্য আগস্টের সেই নির্মম হত্যাকান্ডের আরও প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
সেদিন যা ঘটেছিল: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতিপ্রত্যুষে ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বারের বাসভবনে কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালায় ঘাতক দল। সে নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। লুঙ্গিতে জড়ানো শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ। এভাবেই নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরপরই স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। অপপ্রয়াস চালানো হয় বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাস মুছে ফেলারও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে বারবার কাটাছেঁড়া করা হয় সংবিধানকে। যাতে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ সংবিধানে উপেক্ষিত হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অপসারণ, হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিও চালু হয়। গণতন্ত্রকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। চালু হয় সামরিক একনায়কতন্ত্র। সেই সাথে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনি মোশতাক, ফারুক, রশিদচক্রকে হত্যাকান্ডের দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইন করে খুনিদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করা হয়। রুদ্ধ করে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ।
কিন্তু এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে-বিদেশে বঙ্গববন্ধু হত্যার বিচারের জোর দাবি ওঠে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশের গণতন্ত্রকামী শান্তিপ্রিয় বিবেকবান মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত করে। বিচারে নিম্ন আদালত ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতের এ রায় হাইকোর্টও বহাল রাখেন। কিন্তু ২০০১ সালের পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ না দেয়াসহ নানা কারণে বিচারের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে রায় কার্যকরে বিলম্ব হতে থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালতের পর্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। এই রায় কার্যকর করার মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। তবে এখনো দন্ডপ্রাপ্ত ৫ খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। যাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর হত্যায় যারা ষড়যন্ত্র করেছে, সহযোগিতা করেছে তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সারাদেশে সাধারণ ছুটি থাকবে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোতে অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা।
১৫ আগস্টকে সামনে রেখে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এবারও সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি। দিবসটিকে এরইমধ্যে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশে মসজিদসমূহে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার মুদ্রণ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার স্থাপিত হবে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু একাডেমি এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জীবনী ভিত্তিক বক্তৃতার আয়োজন করবে।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবসে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে তারা কর্মসূচি পালন করবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিস্থলে এবং ঢাকায় ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা করবে।
দেশের সব সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য জাতীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন সংস্থা ও দপ্তরের মাধ্যমে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সংগতি রেখে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, নিরীক্ষা, নবারুণ, সচিত্র বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ কোয়ার্টারলির বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, স্মরণিকা ও বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ, আলোচনা সভা ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করবে। গণযোগযোগ অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শব্দযন্ত্র সরবরাহ করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ দুটির পাঠ আগস্টে মাসব্যাপী প্রচারের ব্যবস্থা করবে এবং কিউরেটর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।