বাবুল নয়, বিউটিকে খুন করেন বাবা-চাচা!

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০১৮, ০২:১১

জাগরণীয়া ডেস্ক

ধর্ষণ করলেও বিউটির খুনের সাথে সম্পৃক্ত নয় বাবুল, বরং বিউটির পড়শী চাচা বিউটি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। আর তার সাথে সহযোগিতায় ছিলেন বিউটির বাবা ছায়েদ আলি।

বিউটির বাবা ছায়েদ আলি ও চাচা ময়না মিয়ার আদালতে দেয়া জবানবন্দির বরাত দিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে হবিগঞ্জের পুলিশ। ৭ এপ্রিল (শনিবার) সন্ধ্যায় জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) বিধান ত্রিপুরা সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেন।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরার  বলেন, ১০ হাজার টাকায় একজন ভাড়াটে খুনির মাধ্যমে বিউটির হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে ঐ ভাড়াটে খুনিকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। তদন্তের স্বার্থে তার নাম এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, লাখাই উপজেলার গণিপুরের নানীর বাড়ি থেকে বিউটিকে হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে গত ১৬ মার্চ বটতলায় নিয়ে যান ময়না, ছায়েদ ও তাদের ভাড়াটে খুনি। সেখানেই ছুরি দিয়ে পাঁচবার আঘাত করে বিউটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।

কেন নিজ পরিবারের দ্বারা খুন হলেন বিউটি আর কেনই বা বাবুলের ধর্ষণ করলো সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এসপি বলেন, বাবুলের মা কলম চাঁন বিগত ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী ছিলেন ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। কিন্তু তিনি নির্বাচনে হেরে যান। কথা ছিল কলম চাঁন নির্বাচনে আসমার পক্ষ হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু কথা না রেখে কলম চান ভোটে দাঁড়িয়ে আসমাকে হারিয়ে দেন। এরপর উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তারপর থেকেই কলম চাঁনকে আটকাতে মরিয়া হয়ে উঠেন ময়না মিয়া। 

এদিকে, শায়েস্তাগঞ্জের ওলিপুরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে বাবুল। বেশ কিছুদিন আগে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে বিয়ে করে বাবুল। প্রভাবশালী বাবুলের এক পর্যায়ে নজর পড়ে বিউটির উপর। তাকে কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলে প্রলোভন দেখায় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। গত ২১ জানুয়ারি বাবুল মিয়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিউটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। স্ত্রী পরিচয় দিয়ে অলিপুরের একটি ভাড়া বাসায় বিউটিকে নিয়ে উঠে বাবুল। ১৭ দিন সেখানে বিউটিকে আটকে রাখা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর বিউটিকে বিয়ে করার জন্য দু’দফায় গ্রাম্য সালিশ ডাকা হলেও বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। বিউটিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান বাবুল।

হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে গত ৪ মার্চ বিউটিকে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়। সেই মামলায় সাক্ষী হিসেবে ছিলেন ময়না মিয়া। এরমধ্যে ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় নেয়া হয়। মেডিকেল পরীক্ষার পর সে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সেখানে বিউটি উল্লেখ করে, সে স্বেচ্ছায় বাবুলের সাথে গিয়েছিল এবং বাবুল তাকে বিয়ে করলে সে মামলা তুলে নিবে। বাড়িতে বিউটিকে এনে দিশেহারা হয়ে পড়ে ছায়েদ। পরে বিউটিকে নিকটস্থ লাখাইয়ের গুণিপুর গ্রামে তার নানী ফাতেমা বেগমের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এরপর থেকেই ময়না মিয়া বিউটির বাবা ছায়েদ আলিকে নানা কুমতলব দেয়। ছায়েদকে বুঝায়, বিউটির আর বিয়ে হবে না। বিউটির কারণে তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এরচেয়ে বিউটিকে মেরে ফেলে তার মৃত্যুর দায়ভার মা কলম চান ও তার ছেলে বাবুলের ঘাড়ে ফেলে দেয়া যায়। কেউ সন্দেহ করবে না। এতে প্রলুব্ধ হয়ে ওঠেন বিউটির বাবা ছায়েদ আলী। তিনিও রাজি হয়ে যান। এরপরই বিউটিকে মেরে মা-ছেলেকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করে ময়না মিয়া।

মরদেহ উদ্ধারের পর বিউটির নানী ফাতেমা বিউটির বাড়িতে গেলে তাকে চুপ থাকার জন্য শাসানো হয়। যদি আদালতে সেদিন রাতের বিস্তারিত বর্ননা দিয়েছেন তিনি।

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বিউটির নানী ফাতেমা বলেন,চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সেদিন ময়না মিয়াই বিউটিকে নিয়ে গিয়েছিল। সাথে ছিলেন ছায়েদ আলি ও আরেকজন ব্যক্তি যাকে ফাতেমা চিনতে পারেননি।

পুলিশ সুপার জানান, বিউটি হত্যার পর থেকেই অস্বাভাবিক ছিল ছায়েদ আলির আচরণ আর সন্দেহজনক ছিল ময়না মিয়ার গতিবিধি। তারপর থেকেই মোবাইল ট্র্যাকের মাধ্যমে তথ্য ঘেঁটে এই দুজনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায় পুলিশ। এরপরই গত ৫ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নিজেদের দোষ স্বীকার করেন ময়না মিয়া ও ছায়েদ আলি। এ ঘটনার সাথে জড়িত ভাড়াটে খুনিকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

মামলার প্রধান আসামি বাবুল সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন উল্লেখ করে এসপি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুল অন্যতম হোতা। তাকে অবশ্যই অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।

উল্লেখ্য, গত ২১ জানুয়ারি শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের দিনমজুর সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে (১৪) বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় পর বিউটির বাবা ছায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা স্থানীয় ইউপি মেম্বার কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। 

১৭ মার্চ বিউটি আক্তারের লাশ হাওরে থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর বিউটির বাবা ছায়েদ আলি বাবুল মিয়াসহ দুজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর ২১ মার্চ পুলিশ বাবুলের মা কলমচান ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ঈসমাইলকে আটক করে পুলিশ। এরপর গত ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে সিলেটের বিয়ানিবাজার এলাকার রামদা গ্রামে ফুফুর বাড়ি থেকে এই মামলার মূল আসামি হিসেবে অভিযুক্ত বাবুলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৯। ৩১ মার্চ (শনিবার) তাকে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়। গত ১ এপ্রিল বিকেলে হবিগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আছমা বেগমের আদালত বাবুল মিয়ার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গত ৬ এপ্রিল হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবুল বিউটি হত্যা ও ধর্ষণের দায় স্বীকার করেন। এরপরই বিউটির চাচা ময়না মিয়া ও বাবা ছায়েদ আলির জবানবন্দিকে কেন্দ্র করে ঘটনা অন্য মোড় নেয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত