তিস্তার ভাঙ্গনে নীলফামারীতে স্মরণকালের বন্যা
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০১৬, ১৭:০১
নীলফামারীতে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা নদীর পানি মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) সকাল থেকে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও নদীর তীব্র ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারন করেছে। আশ্রয় হারানো বানবাসী পরিবারগুলো বিভিন্ন বাধে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভাঙ্গন কবলিত অনেকেই বলছেন, তিস্তায় এবার স্মরণকালের বন্যা হয়েছে।
গত রবিবার (১৭ জুলাই) টানা বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি তৃতীয় দফা বিপদসীমা অতিক্রম করলেও সোমবার পানি বিপদসীমায় নেমে আসে। তবে তিস্তায় ঘরবাড়ি বিলিন হওয়ায় অসহায় পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে নদীর বিভিন্ন বাধে আশ্রয় নিয়েছেন। আসবাবপত্রসহ ঘরবাড়ি অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়া গেলেও রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্টসহ যাতায়াতের মাধ্যমগুলোও ইতিপুর্বে নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। একদিকে বন্যার পানি অন্যদিকে বৃষ্টি-উপেক্ষা করে পরিবারের আপনজনদের নিয়ে নৌকায় রাত-দিন তিস্তার বুক পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন।
দীর্ঘদিন থেকে টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের একতারচর, পুর্বখড়িবাড়িসহ ১০টি গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার বসবাস করলেও তিস্তার ভাঙ্গনে জমি, বসতভিটাসহ নদীতে বিলিন হওয়ায় অসহায় পরিবারগুলো তিস্তা নদী রক্ষায় নির্মিত বিভিন্ন বাধে আশ্রয় নিয়েছেন। টানা ভারী বর্ষনে বানবাসী পরিবারগুলো একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
গত সোমবার রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম, টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন, খালিশা চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকার শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ করেন।
লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের ঠাংঝাড়া, বাঘের চর, পাশশেখ সুন্দরসহ ওই ইউনিয়নে ৬টি ওয়ার্ডে প্রায় ২ শত পরিবারও বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডাক্তার জেড এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম বন্যায় দুর্গতদের সার্বক্ষনিক যোগাযোগের পাশাপশি জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ী ও টাবুর চরের ২৮১টি ও খালিশা চাপানি ইউনিয়নের খোকার চরের ২৩টি পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২ বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ ৬ হাজার টাকার প্রস্তাব ত্রাণ মন্ত্রাণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসন মঙ্গলবার জরুরী ভিত্তিতে ৩৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছেন। বাঁধের আশ্রিত পরিবারদের জন্য ২টি নলকুপ ও ১০টি স্যানিটারী ল্যাট্রিন তৈরির কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।
পূর্ব খড়িবাড়ী গ্রামের বুধা মন্ডল (৮০)বলেন, ‘দীর্ঘ ৫৪ বছর বসবাস করার পর সর্বনাশা তিস্তা আমাগোর জমি, বসতবাড়িসহ সব শ্যাস কইরা দিলো, একদিনে পথের ফকির বানাইয়া দিলো গো’।
সোমবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যায় হতে এ পর্যন্ত তিস্তার গ্রোইন বাঁধে ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।
একতার বাজার সংলগ্ন দিঘীর পাড়ের মোসলেম উদ্দিন (৪২) বলেন, ‘আমরা মৃত্যুশম অনেক কষ্টে আছি। আমাগোর ভিটামাটি নিমিষেই তিস্তায় বিলিন করে দিল’।
একই গ্রামে মৃত মইমুদ্দিনের স্ত্রী সুরতন বেওয়া (৫৫) বলেন, ‘তিনমাস আগে পুত্রটারে বাড়ির ভিটায় করব দিছি। বন্যার পানিতে তার কবরটিও ভেসে গেছে। ৬ মাইনসের সংসার এখন ক্যামনে চলবে বলে মাটিতে লুঠিয়ে পড়ে কান্নায়। স্বামীটা মরার পর স্বামীর কবরের পাশে পোলাটার কবর দিছি আর এখন বানে সব শেষ হইয়া গেল’।
টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন বলেন, তিস্তার পানি বিপদসীমার নিচে আসার সঙ্গে পুর্বখড়িবাড়ি, চরখড়িবাড়ী, ঝিঞ্জিরপাড়া, টাবুর চর, একতার বাজারসহ সহস্রাধিক পরিবারের বসতভিটা ও কয়েকশত হেক্টর জমি, রাস্তাঘাট, ক্লিনিক, স্কুল, ব্রিজ, কালভার্ট, নদী গর্ভে বিলিন হচ্ছে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন জানান, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তালিকা করে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে ৩৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বানবাসীদের দাবি সরকার হতে যা ত্রাণ এসেছে তা পর্যাপ্ত নয়। তাই সমাজের বিত্তবান মানুষদের আন্তরিক হয়ে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বন্যায় কবলিত পরিবারগুলো।