পাঁচ বছরেও বিচার হয়নি তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ১১:১২
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ভেতরে আটকা পড়ে অন্তত ১১৩ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া আহত ও দগ্ধ হন আরও দুই শতাধিক শ্রমিক। এরই মধ্যে চলে গেল পাঁচটি বছর। এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।
অভিযোগ আছে, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সব শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। আর মালিক দেলোয়ার হোসেনের কোনো শাস্তি হয়নি।
এদিকে এ দুর্ঘটনায় পঙ্গু সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে তাদের পরিবার।
জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিজিএম) আদালতে তাজরীন ফ্যাশনের এমডি দোলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটভুক্ত বাকি আসামিরা হলেন- তাজরীন ফ্যাশনের চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল-আমিন, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন ও লোডার শামীম মিয়া।
২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে দুর্ঘটনার প্রায় ৩ বছর পর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে চারজন পলাতক ও অন্যরা জামিনে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলায় গত এক বছরে দুজন সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলায় সাক্ষী ১০৪ জন। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জজ ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে।
জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী এ টি এম গোলাম গাউছ বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। সে জন্যই কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ পরিষ্কার। রাষ্ট্র ও আদালত চাইলে তাজরীনের মামলার রায় তো পাঁচ মাসেই হয়ে যেতে পারে। পাঁচ বছর লাগে না।’
তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ পোশাকশ্রমিকের পরিবার এবং আহত পোশাকশ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ও তাজরীন ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রাস্ট। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫৮২ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। একজন নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ক্ষতিপূরণ ছিল সাড়ে ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আহত একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩ হাজার ও সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা পেয়েছে।
প্রতিবেদনের শুরুতে জরিনা বেগমের কথা বলেছিলাম। তিনি আহত হওয়ার পর আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে দেড় লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন, বাকি টাকা তার স্বামী নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে ময়মনসিংহে বোনের বাড়িতে থাকেন জরিনা।
তাজরীনে হেলপার পদে কাজ করতেন আলেনূর। আগুন লাগার পর চারতলার জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পাশের টিনের চালের ওপর পরে বেঁচে যান। তবে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তাঁর। মাথা ফেটে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি মোটামুটি সুস্থ।
আলেনূর বর্তমানে রংপুরের পায়রাবন্দে শ্বশুরবাড়ি থাকেন। তার স্বামী হামিদুজ্জামান বলেন, ‘আলেনূর মোটামুটি সুস্থ, ঘরের টুকটাক কাজ করতে পারে। তবে প্রতিদিন তাকে ৬৫ টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়। এক বেলা ওষুধ না খেলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ তিনি বলেন, আলেনূরের চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে সব সঞ্চয় শেষ হয়েছে। ভবিষ্যতে কী হবে জানেন না তিনি।
এদিকে, তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন আলাদা বিবৃতিতে দেলোয়ার হোসেনের বিচার দাবি করেছে। এছাড়া ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দেলোয়ার হোসেনের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু।