গুলশান হামলা: নির্দেশদাতার ছদ্মনাম ‘বাংলার বাঘ’!

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০১৬, ১৭:৪৯

জাগরণীয়া ডেস্ক

গুলশান হামলার হামলা ও পরিকল্পনারি নির্দেশদাতার ছদ্মনাম ‘বাংলার বাঘ’ বলে জানা গেছে। যিনি বরখাস্ত হওয়া সেই মেজর জিয়ারও বস। শুধু তাই নয় এ হামলা পরিকল্পনার মূল ঘাঁটি ছিল রাজধানীর ভাটারা থানাধীন অভিজাত আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট। এ হামলার সহযোগী হিসেবে ৮ জঙ্গিকে নজরদারিতে আনার পর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২টি মেশিনগান। বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা চিরুনি অভিযান চালিয়ে সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খুঁজছে নির্দেশদাতা সেই ‘বাংলার বাঘ’কে।

ওদিকে নজরদারিতে থাকা তরুণরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। এদের মধ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলী ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রয়েছে। আত্মঘাতী জঙ্গিরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে ব্যবহার করছে অমুসলিম নাম।

তবে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে থ্রিমাসহ কয়েকটি বিশেষ অ্যাপসকে বেছে নিয়েছে। এসব অ্যাপসেও তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে।

গুলশানে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য হামলার তিন মাস আগে রাজধানীর ভাটারা থানার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া করে জঙ্গিরা। ওই বাসা থেকে পরিচালিত হয় গুলশানে হলি আর্টিসান কিলিং মিশন।

নজরদারিতে থাকা জঙ্গি সূত্রগুলো দাবি করছে, এই ফ্ল্যাটই তাদের সদর দফতর। মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।  

তদন্ত সূত্র জানায়, জঙ্গিদের মূল আস্তানার ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সম্প্রতি ফ্ল্যাটটিতে অভিযান চালায়। কিন্তু ফ্ল্যাটে তল্লাশিকালে এক পর্যায়ে পেয়ে যান দুটি একে-২২ রাইফেল। স্বয়ংক্রিয় এসব অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করা সম্ভব। এ অস্ত্রের দুটি ম্যাগাজিন ব্যবহার করে একসঙ্গে ৭৮ রাউন্ড পর্যন্ত গুলি করা যায়, যা ব্রাশফায়ার নামে পরিচিত। মামলার এজাহারে অত্যাধুনিক এই রাইফেলকে মেশিনগান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানা গেছে, উদ্ধারকৃত এই অস্ত্র এসেছে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে। বিহারের অস্ত্র কারখানাটি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের নির্মিত বলেও অস্ত্রের গায়ে খোদাই করে দেয়। বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছে (এবিটি) এরকম কমপক্ষে ১২টি ও জেএমবির কাছে ৬টি একে-২২ মেশিনগান আছে। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র অস্ত্র।

জঙ্গিদের হাতে থাকা পুরো অস্ত্রভাণ্ডারে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিটি পুলিশ। ছদ্মবেশী আত্মঘাতীরা বিভ্রান্তকর তথ্য দেওয়ায় এসব অস্ত্রভাণ্ডারের সঠিক খোঁজ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারতের বিহার থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে এসব অস্ত্র আসে রাজধানীতে। বিহারের ওই অস্ত্র কারখানা থেকে প্রতিটি একে-২২ বোরের মেশিনগান কিনতে জঙ্গিদের খরচ পড়ে ৯০ হাজার টাকা। অথচ আমেরিকা বা রাশিয়ার তৈরি এ রকম একটি অস্ত্রের দাম ৪ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভাটারা ফ্ল্যাট থেকেই নিরবাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ১ জুলাই সন্ধ্যায় হেঁটে হলি আর্টিসানে যান। তল্লাশি এড়াতে কৌশল হিসেবে বেছে নেয় ইফতার পরবর্তী সময়কে। তাদের মধ্যে দু’জন নর্দা কালাচাঁদপুর হয়ে ইউনাইটেডের পাশ দিয়ে এবং দু’জন নতুন বাজার হয়ে এবং পরে একজন নর্দা হয়ে হলি আর্টিসানে যায়। গুলশান হামলায় নিহত ৫ জঙ্গির মধ্যে নিরবাস ইসলাম ঝিনাইদহ থেকে ভাটারার ওই আস্তানায় এসে গুলশান হামলায় যোগ দেয়।

এর আগে সে তিন মাস ধরে ঝিনাইদহের সোনালীপাড়া এলাকায় একটি মেসে তার আরও ছয় সহযোগীকে নিয়ে অবস্থান করে। ওই সময় তারা ঝিনাইদহে বেশ কয়েকটি জঙ্গি অপারেশন করে। অথচ নিবরাস ইসলামের বাসা ঢাকার উত্তরায়। সে নর্থ সাউথ ও মালয়েশিয়াস্থ মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তার বাবা নজরুল ইসলাম একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।

এদিকে গুলশান হামলার তদন্তে ইতিমধ্যে বড় ধরনের সাফল্য ধরা দিয়েছে। এই হামলা পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জেএমবির ৮ আত্মঘাতীকে নজরদারির মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বগুড়া ও চট্টগ্রামে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তারের খবর আসতে পারে। 

সূত্র জানায়, এসব আত্মঘাতীর মধ্যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথসহ একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বেশ কয়েকজন ছাত্র রয়েছে।

অপরদিকে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় বড় অগ্রগতি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) চট্টগ্রামে একজনকে নজরদারির জালে আটকে ফেলা সম্ভব হয়েছে।

জানা গেছে, জেএমবি সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে। ইমো, ভাইবারের মতো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব ধরনের যোগাযোগ করা যায় এই অ্যাপসে। তবে এটি অপ্রচলিত ও আরও আধুনিক। এই অ্যাপস ব্যবহারের তথ্য কোনোভাবেই নজরদারির মধ্যে আনা সম্ভব হয় না। আর এই অ্যাপসে তাদের জঙ্গি প্রধানের নাম ‘বাংলার বাঘ’। তবে তার বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাকে শনাক্ত করতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবি সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছে, নেতার সামনে নেওয়ার আগে তাদের এক ধরনের বিশেষ সানগ্লাস পরিয়ে নেয়া হয়। যে কারণে তারা নেতার চেহারা দেখতে পারেন না। ‘বাংলার বাঘ’ ছদ্মনামের ওই ব্যক্তি বরখাস্ত হওয়া সেই মেজর জিয়ারও বস। অবশ্য মেজর জিয়া আগেই নজরদারির মধ্যে চলে এসেছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিশেষ নজরদারিতে থাকা জেএমবি সদস্যদের কারও ছদ্মনাম ‘চকলেট’, কারও নাম ‘মারজান’, কেউ আবার ‘মেঘ’ নামে পরিচিত। অনেক জঙ্গি নিজেদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করতে কৌশল হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নাম ব্যবহার করে।

রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারী এক জেএমবি কর্মী ভারতের দু’জন বিখ্যাত নেতার নাম ব্যবহার করে। তাদের একজনের নাম ‘রাজীব গান্ধী’ অপরজন ‘সুভাষ বসু’। তাদের বিষয়ে ইতিমধ্যে অনেক তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র যার ছদ্মনাম ‘রাহুল’। কথিত এই ‘রাহুল’ একসময় ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল। পরে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। সে জেএমবির উত্তরাঞ্চলের প্রধান। পুরোহিত হত্যাসহ উত্তরাঞ্চলে অসংখ্য হামলায় ওই জেএমবি নেতা সরাসরি অংশ নেয় বলে জানা গেছে। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে ওইসব হত্যাকাণ্ডের অনেক অজানা রহস্য জানা যাবে।  

সূত্রমতে, জেএমবি ও এবিটি কর্মীরা মনে করে, এই সরকার তাগুত (শয়তানি শক্তি)। সরকারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তাগুতের অনুসারী। তাই তারা এই সরকারের বিচার ব্যবস্থা, আইন-কানুন কোনো কিছুই মানে না। তারা দেশে একটি কথিত ‘শরিয়া’ আইন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। তারা পুলিশ সদস্যদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিও দিচ্ছে।

এদিকে গুলশান ট্রাজেডি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাদের বর্ণনা থেকে জেনেছেন, ঘটনার দিন ১ জুলাই রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে জঙ্গিরা হোটেলটিতে হামলা করে। প্রবেশ করেই তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়। একে-২২ মেশিনগান থেকে বিদেশীদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। এলোপাতাড়ি গুলিতে অনেকে নিহত হন। কয়েকজন যারা আত্মগোপন করেছিলেন তাদেরও ধরে এনে হত্যা করে।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যারা আধমরা ছিলেন তাদের ছুরি ও চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। বিশেষ করে নারীদের ওপর তারা বেশি নির্মম নির্যাতন করে। হিংস্রতার চিহ্ন হিসেবে নারীদের শরীর কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। এক ঘণ্টার মধ্যে তারা কিলিং মিশন বাস্তবায়ন শেষে সটকে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের এসআই রিপন কুমারের নেতৃত্বে টহল টিম তাদের প্রথম প্রতিরোধ করে। টহল টিমের ওপর জঙ্গিরা গ্রেণেড নিক্ষেপ করে। এরপরও টিমের সদস্যরা গুলি অব্যাহত রাখে। এতে জঙ্গিরা আটকা পড়ে। কিছু সময়ের মধ্যেই ডিবির গুলশান জোনাল টিম ঘটনাস্থলে যান। এর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যান গুলশান জোনের উপ-কমিশনার মোস্তাক আহমেদ ও এসি আবু তাহের মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তাদের পেছনে ছিলেন বনানী থানার ওসি। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছার মিনিট ত্রিশেক পর যান ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাবের ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গত, ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের একজন ও বাংলাদেশের ৩ জন জিম্মি নিহত হয়। এ ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত