‘জিয়া-এরশাদ-খালেদা সবাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষক’
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৭, ১৫:২১
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়া-এরশাদ-খালেদা সবাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের সবাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছেন। পুনর্বাসন, ক্ষমতার অংশীদারও করেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণ পড়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, আজ যারা বলছেন, স্বাধীনতা কারও একক নেতৃত্বে আসেনি— তারা কী ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনেননি? ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর ভাষণে ইয়াহিয়া কেবল বঙ্গবন্ধুর কথাই বলেছিলেন, তাকেই দোষারোপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায়ও ঘোষণা করেছিলেন।
১৬ আগস্ট (বুধবার) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হতে তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে চায়। কিন্তু এ দেশে এখনও কিছু লোক আছে, যারা দেশকে পিছিয়ে নিতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
বক্তৃতার শুরুতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে আবারও দায়ী করেন শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে জিয়াকে খুনিদের দোসর আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, হত্যার মূল হোতা ছিল খুনি খোন্দকার মোশতাক। আর তার দোসর ছিলেন জিয়াউর রহমান। তারা এমনই ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক ক্ষমতায় বসেই জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন। আর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়া এই খুনিদেরই বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। জিয়া যদি খুনিই না হতেন, তাহলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এই হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করতেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারবার এই খুনিদের পুরস্কৃত করার খেলাও দেখেছি। কেউ কেউ খুনিদের নিয়ে দল গঠনও করেছেন। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর খুনি হুদা ও রশিদকে নিয়ে ইত্তেফাক কার্যালয়ে বসে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। জেনারেল এরশাদ খুনিদের দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করে কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। আর খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির অবৈধ নির্বাচনে খুনি ফারুক-রশিদকে সংসদে বসিয়েছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতাও করেছেন। জিয়া-এরশাদ-খালেদা বারবার খুনিদের পুরস্কৃত করেছেন; ক্ষমতার সাথী করেছেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তের জন্য ব্রিটিশ এমপির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই কমিশনের সদস্যদেরও এ দেশে আসতে বাধা দিয়েছিলেন। ভিসা দেননি। জিয়া যদি জড়িতই না হবেন, তাহলে তদন্ত কমিশনকে কেন এ দেশে আসতে বাধা দিয়েছিলেন? জিয়াউর রহমান নির্দোষ হলে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে দিতেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, একজনের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি। যারা এই কথাটা বলছেন, তাদের বলব— ইয়াহিয়ার ভাষণটি যেন পড়ে দেখেন।
বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এটা তো ঠিক, এককভাবে কোনো কাজ করা যায় না। তার জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে হয়; জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। জনমত গড়তে হয়। মানুষকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। কিন্তু এসবের জন্যও একজনকেই নেতৃত্ব দিতে হয়। জাতির পিতা সেই কাজটিই করেছেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের জন্য আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণকে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য ধাপে ধাপে সংগ্রাম করেছেন। দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, অনেক কথাই শুনি। সব কথার জবাব দেওয়ার সময় আসেনি। সেই সময়ও আসবে। একটি কথাই বলতে চাই— এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য জাতির পিতা রক্ত দিয়ে গেছেন। তার সেই রক্তের ঋণ তখনই শোধ হবে, যখন এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। তারা সুখী, সুন্দর, দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন পাবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডে বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর কথা তুলে ধরতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মা কী অপরাধ করেছিলেন, আজও বুঝে উঠতে পারি না। তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের ছোট্ট শেখ রাসেল, ভ্রাতৃবধূসহ সবাইকে হারিয়েছি। বিদেশে থাকায় সেদিন আমি আর শেখ রেহানাই কেবল বেঁচে গিয়েছিলাম। মানুষ একটি শোকই সইতে পারে না। আর আমাদের দুই বোনকে সবাইকে হারানোর যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে। এমনকি বাবা-মা-ভাইদের বিচারও চাইতে পারিনি। বিচার করতে দেওয়া হয়নি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আজ একটি হত্যাকাণ্ড হলেই সবাই বিচারের জন্য সোচ্চার হন। কেউ তো একথা বলেন না, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল, তাদের কেন বিচারের মুখোমুখি না করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল? তাদের প্রতি কী মানুষের ঘৃণা থাকবে না? তারাই এ দেশের ক্ষমতায় থাকবে? আর তাদেরই ক্ষমতায় আনার জন্য ষড়যন্ত্র হবে? ক্ষমতায় আছি বলে সবাই বিচার চাইতে আসেন? কিন্তু আমি তো পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চাইতেও পারিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আজ যখনই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নত হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে— তখনই নতুন করে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এখন কেউ যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে আমাদের কী করার আছে? কেউ যদি নির্বাচনে না এসে ভুল করে, সেই ভুলের খেসারত কেন দেশের মানুষকে দিতে হবে? তার জন্য বহু সংগ্রামে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কেন ধ্বংস করতে হবে? আজ দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে গত নির্বাচন বানচালের আন্দোলনের নামে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের দেশজুড়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার বিবরণ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অত্যাচার-নির্যাতন, খুন-খারাবি, দুর্নীতি-লুটপাটই তাদের কাজ। যারা মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, তাদের ওপরই আঘাত করতে চায় তারা। এদের দোসর দেশের কিছু মানুষ; যারা নিজেদের জ্ঞানী-গুণী আর বুদ্ধিজীবী ভাবেন। কিন্তু কাজের বেলায় অন্যটা করেন। কেন— দেশের মানুষের কী বেঁচে থাকার অধিকার নেই? তারা কী একটু ভালো করে খেয়েদেয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে না? তারা কী উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন পাবে না?
এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর যেন কেউ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। বাংলাদেশের মানুষ যেটুক এগিয়েছে, উন্নত জীবনের সম্ভাবনা গড়ে তুলেছে, তা যেন কেউ ব্যাহত না করতে পারে। এ জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক-কলামিস্ট আবেদ খান, নাট্যজন আতাউর রহমান এবং শহীদ জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি এমপি প্রমুখ।
এতে কবিতা আবৃত্তি করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শোক সঙ্গীত পরিবেশন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
সূত্র: বাসস