আলো ছড়াচ্ছেন মর্জিনা বেগম
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৪৭
নারী আন্দোলনে পথিকৃৎ ছিলেন বেগম রোকেয়া। তারই জন্মভিটা পায়রাবন্দে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি উন্নয়নের মডেল হিসেবে আধুনিক কৃষির আলো ছড়াচ্ছেন মর্জিনা বেগম। ইতিমধ্যে কৃষি ও দেশ উন্নয়নে অধিক পরিশ্রমী নারী চাষি হিসেবে খেতাবও পেয়েছেন তিনি।
মর্জিনা জানান, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চুহড় গ্রামে তার বাড়ি। বাবার বাড়ি ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারী ঝাড় এলাকায়। ১৯৮০ সালে হামিদুর রহমান নামের স্বল্প বেতনভুক্ত একজন সরকারি চাকরিজীবীকে বিয়ে করেন তিনি। বিবাহিত জীবনে যৌথ পরিবারে বসবাস করা অবস্থায় তাদের সংসারের অবস্থা আর্থিকভাবে শোচনীয় হয়ে পড়ে। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। কিন্তু এতে হতাশ হননি তিনি। সংসারের খরচের টাকা জমিয়ে ১৯৯৮ সালে সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে চুহড় এলাকায় চার একর জমি বন্ধক নেন। এরপর সেখানে হাত দেন কৃষির বহুমুখী উৎপাদনে।
একইসাথে তিনি সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন কাজসহ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের কাজেও অংশ নেন। প্রতিবছর তার কাজের বিষয় ও পরিধি বাড়তে থাকে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য আসে তার।
মর্জিনা বেগমের এমন তৎপরতায় বদলে যাচ্ছে পায়রাবন্দ এর চিত্র। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্র পরিণত হচ্ছে অনুকরণীয় মডেলে। পরিবেশবান্ধব ফসল ও শাক সবজি উৎপাদন, সমাজ উন্নয়ন ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে তার। গত বছরই নিজের অভিজ্ঞতা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে হেক্টর প্রতি ৩২ মেট্রিকটন আলু, বাংলামতি বোরো ধান (ব্রি ধান-৫০) হেক্টর প্রতি সাড়ে ছয় মেট্রিকটন, ভুট্টা হাইব্রিড জাত হেক্টরপ্রতি ১০ মেট্রিকটন ফলন উৎপাদনসহ জৈব পদ্ধতির মাধ্যমে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশার অধিক উৎপাদন করে এলাকায় চমক সৃষ্টি করেছেন মর্জিনা।
নিজে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) খামার স্থাপন করে গ্রামের নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এলাকায় তিনি প্রথম তার স্বামীর সহায়তা নিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট খামার স্থাপন করে পরিবেশবান্ধব ফসল উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে পায়রাবন্দ এলাকায় বহু নারী-পুরুষ তার পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এসব কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে মর্জিনা বেগমকে নারীদের ক্ষেত্রে 'রোল' মডেল এর খেতাব দেয়া হয়েছে।
উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে চলতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজস্ব খাতে ভুট্টা প্রদর্শনী ৫০ শতক এবং নিজের ৫০ শতক জমিতে পরিবেশবান্ধব সুপার ৭০২ জাতের ভূট্টা চাষ করে উত্তরাঞ্চলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন মর্জিনা বেগম। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মনজুরুল হান্নান, রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শাহ আলম, রংপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ স ম আশরাফ আলী, রংপুর বেতারের আঞ্চলিক কৃষি অফিসার আবু সায়েম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ খোরশেদ আলমসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মর্জিনা বেগমের ভুট্টাক্ষেত পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা মর্জিনা বেগমকে কৃষি ও দেশের উন্নয়নে অধিক পরিশ্রমী নারীচাষি খেতাব দিয়ে তার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এলাকার কৃষকরা জানান, নারী যে পুরুষের কোনও অংশে কম নয়- তা প্রমাণ করেছেন মর্জিনা বেগম। তার চাষকৃত ভুট্টাক্ষেত, বাংলামতি, ধানক্ষেত, আলুক্ষেত, ভার্মি কম্পোস্টসহ অন্যান্য সফল কার্যক্রমগুলো সরেজমিনে দেখে অভিজ্ঞতা নিয়ে তারাও তাকে অনুসরণ করছেন। পায়রাবন্দের চুহড় গ্রামের নারীচাষি কৃষি ও দেশ উন্নয়নের 'মডেল' মর্জিনা বেগমের কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত হলে দেশ ২০২১ সালের মধ্যে সরকারের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তারা।
পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়জার রহমান খান বলেন, "কৃষি উন্নয়নে মর্জিনা বেগম আধুনিক চাষাবাদে নিজেই মাঠে কাজ করেন। তার সুবাদে এলাকার অন্য নারীরাও কৃষিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করে সংসারের স্বচ্ছলতা এনেছেন"।
কৃষিকাজ করেই সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করছেন মর্জিনা বেগম। বড় ছেলে মাসুদুর রহমান বিবিএ পাস করেছেন, দ্বিতীয় ছেলে মশিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স প্রথম ক্লাস পেয়েছেন, তৃতীয় ছেলে হাসিবুল হাসান রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম সেমিস্টারে লেখাপড়া করছেন, চতুর্থ ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ও পঞ্চম ছেলে মেহেদী হাসান কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
তবে মর্জিনা জানান, কৃষিতে ব্যাপক সাফল্যের কারণে ছেলেদের পেছনে লেখাপড়ার খরচ যোগান দিতে তাকে আর হিমশিম খেতে হচ্ছে না।
মর্জিনা বেগম জানান, সব সময় তার স্বামী হামিদুর রহমান ও ছেলেরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাকে সহযোগিতা করছেন। তবে অবসরগ্রহণের পর তার অসুস্থতার কারণে সংসারে বহু টাকা খরচ হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
তিনি বলেন, "শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির অভাবেই আমাদের দেশে নারীরা এখনও পিছিয়ে। অসাধ্য বলে কিছু নেই। আমার কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে এলাকায় অনেক নারী-পুরুষ কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন। এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে- এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া"।