অজান্তেই অনলাইনে চলে যাচ্ছে আপনার তথ্য
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৩:০০
পিসি পিটস্টপ নামের এক সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালে তাদের সফটওয়্যার ব্যবহারের চুক্তিপত্রে এক শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। সেই শর্ত পড়ে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে যোগাযোগ করবে, তাকে ১ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। এক ক্রেতা যোগাযোগ করেছিলেন বটে; তা-ও পাঁচ মাস পরে। তত দিনে সফটওয়্যারটির ৩ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে। ঘটনাটি কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক যুগ পরে এখনো সেই উদাহরণ টানা হয়। কারণ ‘এন্ড ইউজার লাইসেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ হোক আর ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন’-ই হোক, এখনো সবাই ‘বাই ক্লিকিং ওকে ইউ কনফার্ম দ্যাট ইউ হ্যাভ রিড...’ অংশে ‘কনফার্ম’ করেন বটে, কিন্তু ‘রিড’ করেন না। অর্থাৎ, চুক্তির নিয়মকানুনের মধ্যে যতই লেখা থাকুক যে ‘ওকে’ করা মানে ধরে নেওয়া হবে যে গ্রাহক চুক্তির পুরোটাই পড়েছেন, বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই ‘ওকে’ বা ‘অ্যাগ্রি’ করেন ঠিকই, কিন্তু পড়ে দেখেন না।
আপনি যখন ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে কোনো ওয়েবসাইট দেখছেন, গুগলে তথ্য খুঁজছেন কিংবা ফেসবুকে ব্যক্তিগত বার্তায় যে কথাগুলো লিখছেন তার কোনোটাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির বাইরে থাকে না। প্রতিষ্ঠানগুলো যে এমনটা করছে তা কিন্তু আবার বেআইনিও নয়। কারণ আপনি পড়ে বা না পড়ে শর্ত মেনেই তাদের সদস্য হয়েছেন। আপনি নিজেই আপনার ব্যক্তিগত তথ্যে তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছেন। এ তো গেল একটা দিক, বিনা মূল্যের এই সেবাগুলো আপনার তথ্য যে কী পরিমাণ মূল্যে বিক্রি করছে, তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
অনলাইন সেবা কি বিনা মূল্যের?
ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো যতটা না বিনা মূল্যে আপনাকে সুবিধা দিচ্ছে, তার চেয়েও বেশি মূল্যের তথ্য নিচ্ছে আপনার কাছ থেকে। কীভাবে? সাধারণত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আপনি তথ্য খোঁজা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার কিংবা অনলাইনে গেম খেলা থেকে শুরু করে খবরও পড়েন বিনা মূল্যে। এটা আসলে তথ্যের বিনিময়ে সেবা, যেখানে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো আপনাকে সেবা দেওয়ার বিনিময়ে ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে দিচ্ছে তৃতীয় পক্ষের কাছে। আপনার পছন্দ, অনলাইনে আপনার চালচলন বুঝে তারা সে অনুযায়ী আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। এখানে পণ্য হলো ব্যবহারকারীর তথ্য, অন্যভাবে বললে ব্যবহারকারী নিজেই।
যেভাবে হয় তথ্যের বিনিময়
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসনের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ফারিহা ইসলাম তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তোলা কিছু ছবি ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলেন। কিছুক্ষণ যেতেই হয়তো ছবিতে ১০০টি লাইক আর ৫০টি মন্তব্য এল বন্ধু ও স্বজনদের কাছ থেকে। ফারিহা তো বেশ খুশি। এ কারণেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁর খুব পছন্দের। তিনি কিন্তু বুঝতে পারছেন না তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের তথ্য কতটা নিরাপদ। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যতটা না সহজ করেছে, তার চেয়ে বেশি করছে নির্ভরশীল। এক মুহূর্তের জন্য শখের স্মার্টফোনটা না থাকলেই মনে হয় কি যেন নেই। আমরা যখন গুগল বা ফেসবুকে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খুলছি, তখন একটা চেক বক্স সব সময়ই পাশ কেটে যাই। সেখানে আপনি নিজেই আপনার ব্যক্তিগত তথ্যে তাদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই শর্ত পড়াটা অনেকাংশেই জরুরি।
যেভাবে তথ্য চলে যায়
যখন বিজ্ঞাপনের কথা চলে আসে, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য তখন অবিশ্বাস্যভাবেই বেশ মূল্যবান। আর ব্যক্তিগত তথ্যের বিষয় এলে তো আর কোনো কথাই চলে না । আপনি যখন ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যারগুলো দিয়ে কোনো ওয়েবসাইট দেখছেন, গুগল বা অন্য বড় সেবাদাতা সাইটগুলো তার বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক থেকে আপনাকে অনুসরণ বা ট্র্যাক করছে। গুগল দিয়েই যদি শুরু করা যায়, তবে সে কথা শেষ করতেও হিমশিম খাওয়ার জোগাড় হবে।
আপনি কী ধরনের ওয়েবসাইট দেখেন, মানে আপনার ওয়েবসাইট দেখার প্রবণতা বুঝে নেয় গুগল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রোগ্রাম ব্যবহার করে গুগল আপনার ‘ব্রাউজিং প্যাটার্ন’ বুঝে নিয়ে আপনার চাহিদাগুলো কুকিতে রেখে দেয়। কুকি হলো একটি টেক্সট স্ট্রিং, যা কোনো ওয়েব সার্ভারের ইউজারের লোকাল স্টোরেজে (হার্ডডিস্ক) সংরক্ষণ করে সাইটের সঙ্গে যোগাযোগকে সহজতর করে। কুকিতে থাকা সব তথ্যই নেম-ভ্যালু পেয়ার আকারে সংরক্ষিত থাকে৷ চাইলেই ব্রাউজারভেদে কুকিগুলো দেখা যায়। ওয়েব সার্ভার কুকি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর বর্তমান উপস্থিতি বুঝে সে অনুযায়ী যোগাযোগ করে থাকে৷ মূলত কুকি দুই ধরনের। সেশান কুকি আর পারসিস্টেন্ট কুকি। সেশান কুকি ব্রাউজার বন্ধ না করা পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ এটি ইউজারের চলতি তথ্য ধারণ করে থাকে। সেশান কুকির মেয়াদকাল খুবই স্বল্প সময়ের হয় এবং ওয়েব ব্রাউজার পুরোপুরি বন্ধ হলেই শেষ হয়ে যায়৷ আর পারসিস্টেন্ট কুকি ব্রাউজার বন্ধ করার পরও সিস্টেমে থেকে যায়৷ এটি মুছে ফেলা যায় শুধু ম্যানুয়ালি অথবা সেগুলোকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া এক্সপায়ার্ড টাইমে পৌঁছালে৷ এই কুকিগুলো একবার শেষ হয়ে গেলে ব্যবহারকারীকে প্রয়োজনীয় অথেটিকেশনের মাধ্যমে ফ্রেশ কুকি তৈরি করতে হয়৷ এ ছাড়া আরও অনেক কুকি রয়েছে।
গুগল যেভাবে তথ্য নেয়
এবার গুগলের বিজ্ঞাপন দেখানোর কৌশলের ব্যাপারে আসি। যেমন, আপনি খেলার খবর নিতে বা দেখতে পছন্দ করেন। তাই নিয়মিত খেলাধুলার যে ওয়েবসাইটগুলোতে বেশি যান বা ইউটিউবে খেলাধুলার ভিডিও বেশি দেখেন। গুগল আপনার ব্রাউজিং প্যাটার্ন অনুযায়ী গুগল কুকিতে স্পোর্টস ইন্টারেস্ট বিভাগে আপনার তথ্য রেখে দেবে এবং দরকারে স্পোর্টস-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনগুলো আপনাকে দেখাবে। এ রকম অসংখ্য ক্যাটাগরি অনুযায়ী তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন দেখায় গুগল। তেমনি অন্যান্য সাইটও আপনাকে তাই দেখাবে, আপনি যা পছন্দ করেন।
গুগলে যুক্ত থাকা (লগ-ইন) অবস্থায় কোন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখতে চান, তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে https://goo.gl/Wmul2F এই ঠিকানার ওয়েবসাইটে গিয়ে। এ ছাড়া গুগল আপনার তথ্য নিয়ে নানামুখী চ্যানেলে তা ব্যবহার করে। আবার আপনি যে আইপি ঠিকানা থেকে গুগলের সেবা ব্যবহার করছেন, ব্রাউজার কুকি বা গুগল কুকি ব্যবহার করেও আপনার থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। এসব ব্যবহার করে গুগল ট্রেন্ডস, গুগল ইনসাইটস ফর সার্চ সেবাগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
ফেসবুক যেভাবে তথ্য নেয়
ফেসবুকে থাকা অবস্থায় নিউজফিডে বন্ধু বা লাইক করা পেইজে কে কী শেয়ার করেছেন সেটি স্ক্রল করছেন। হঠাৎ অ্যাড চলে এল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অ্যাড দেখাতে ফেসবুক আপনার ব্যক্তিগত শতাধিক তথ্য নিয়ে থাকে। আপনার বর্তমান অবস্থান, বয়স, লিঙ্গ, ভাষা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্কুল, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে এমন অনেক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অ্যাড দেখায়। আপনি যতক্ষণ ফেসবুকে লগ-ইন থাকছেন, ঠিক সেই সময় ভার্চুয়ালি অন্য কোনো সাইটে ভিজিট করলে সেটি ফেসবুক জানতে পারে। আপনি লগ-আউট হলেও আপনার অনলাইনে আছেন কি না, ফেসবুক তা পর্যবেক্ষণ করে থাকে। আপনি কখন কোন পেইজে লাইক দিলেন, কার পোস্ট শেয়ার করলেন—সবই পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকে। ফেসবুককে কিছু কোড দেওয়া হয়, যা ফেসবুক পিক্সেল নামে পরিচিত। এটিকে এক্সটেশানও বলা হয়ে থাকে। এটি ব্যবহার করে ভিজিটরকে ফেসবুক দিয়ে লগ-ইন করানো যায়। আপনি কোন অ্যাড দেখবেন, কোনটা দেখবেন না, সেটির নিয়ন্ত্রণও ফেসবুক দিয়ে থাকে। তাতে এই বোঝায় না যে ফেসবুক আপনার ওপর নজরদারি করবে না! আপনি চাইলে ফেসবুকে লগইন থাকা অবস্থায় https://www.facebook.com/ads/preferences/ লিংকে গিয়ে কোন অ্যাড দেখবেন, কোনটা দেখবেন না, সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
তবে উপায়?
আপনি যদি চান ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর কোনো প্রতিষ্ঠান নজরদারি করবে না, কিন্তু তাদের সেবা আপনি ব্যবহার করে যেতে চান! তাহলে বলতে হবে এমন কোনো সুযোগ আসলে নেই। আপনি চাইলেই তাদের সেবা ব্যবহার করুন, কিন্তু বিনিময় ছাড়া বিনা মূল্যে কিছুই জুটবে না। প্রযুক্তির সঙ্গে লড়তে হবে প্রযুক্তির জ্ঞান দিয়েই। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বা ব্রাউজিং কর্মকাণ্ড নিরাপদ রাখতে হলে সজাগ রাখতে হবে নিজেকেই।
সূত্র: প্রথম আলো