হিলি মুক্ত দিবস আজ
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:২৩
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আজকের এই দিনে দেশের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ বাংলাহিলির মুহাড়াপাড়া এলাকায় হয়েছিল বলে দাবি এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধ চলাকালীন এখানে প্রায় ৭ হাজার পাক সেনা নিহত হয়। শহীদ হন প্রায় ১৩০০ মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র বাহিনীর ৩৪৫ জন সদস্য। আহত হন অনেকে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর ৭নং সেক্টরের আওতায় দিনাজপুরের হিলি শত্রু মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ ও গেড়িলা যুদ্ধে হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামের মোস্তফা, একরাম উদ্দিন, বানিয়াল গ্রামের মুজিব উদ্দিন শেখ, ইসমাইলপুর গ্রামের মনিরুদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন, বৈগ্রামের ইয়াদ আলী ও চেংগ্রামের ওয়াসিম উদ্দিন শহীদ হন।
হাকিমপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন জানান, ১৯৭১ সালে দেশে যখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল, বিশেষ করে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে কোনো মুহূর্তে পাকহানাদারদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ বাধতে পারে। এমতাবস্থায় সারা দেশের সঙ্গে হাকিমপুর তথা হিলি এলাকার নেতাদের আহ্বানে সমাজ সেবক খলিলুর রহমান ও ডা. আবুল কাশেমকে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজের উৎসাহিত যুবক, আনসার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে বাংলাহিলি বালিকা বিদ্যালয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা হয়।
২৫ মার্চ পাকহানাদার বাহিনীর বর্বর হামলায় ঢাকা অক্রমণের পর পাকবাহিনীরা যাতে হাকিমপুরে প্রবেশ করতে না পারে সেই লক্ষ্যে হিলির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই গাছ কেটে ও রাস্তা খনন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে থানা ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাছে ৩০৩ রাইফেল হস্তান্তর করা হয়। এসময় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর নিজাম উদ্দিন ১৭টি গাড়ি বহরসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফুলবাড়িতে এসে অবস্থান নেয় এবং ওই স্বেচ্ছাসেবক দলকে হিলি ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার শুকুর আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন ইপিআরকে বিহারী অধ্যুষিত পার্বতীপুরের হাবড়ায় খান সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য পাঠানো হয়। এসময় সেখানে স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে পাকহানাদারদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রচন্ড শেলিং ও বিভিন্ন ধরনের গোলার আঘাতে স্বেচ্ছাসেবক দলের ৯ জন যোদ্ধা শহীদ হন।
জানা যায়, এ যুদ্ধে সবরকম সহায়তা ও অস্ত্র সরবরাহের আশ্বাস দিলেও ওই কমান্ডিং অফিসার মেজর নিজামুদ্দিন অস্ত্র সরবরাহ না করে সরে এসে বিরামপুরে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে বিরামপুরে মেজর নিজামের মৃত্যু হয়। এর কয়েক দিন পর ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলবলসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হিলিতে এসে অবস্থান নেন এবং অত্র এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার গ্রহন করেন।
এদিকে ১৯ এপ্রিল ঘোড়াঘাট ও পাঁচবিবি এ দুই দিক থেকে পাকহানাদার বাহিনীরা রাস্তার উভয় পাশে গুলি বর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করতে করতে ত্রাসের সৃষ্টি করে এবং হিলি আক্রমণ করে। এ অবস্থায় ১৯, ২০ও ২১ এপ্রিল হিলিতে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। মোকাবিলা করতে যেয়ে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের দলের দুইজন শহীদ হন এবং তখন ক্যাপ্টেন আনোয়ার দলবলসহ ভারতের বালুরঘাটের তিওড়ে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত করে পতিরামে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। এসময় ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও তার দলের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেন। বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পটি তৎকালীন এমপি এবং এমসি এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। বিশেষ করে সংগঠক হিসেবে এমপি আজিজুর রহমান (পলাশবাড়ি) ডা. ওয়াকিল, এমএলএ মজিদ চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাটের কুমারপাড়ার কুড়মাইল ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, অধ্যাপক আবু সাইদের (প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী) নেতৃত্বে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক দল মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা হয়। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।
হাকিমপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার লিয়াকত আলী জানান, পাকহানাদাররা হিলি থেকে তিন মাইল পূর্বে ছাতনী গ্রামে শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন দিকে ক্যাম্প গঠনের মাধ্যমে ভারি অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করে এবং মুহাড়া পাড়ায় তারা একটি গভীর খাল কেটে বেশ কয়েকটি বাংকার তৈরি করে। ৬-৭ হাজার পাক সেনা ৪০ টি ট্যাংক নিয়ে সেখানে অবস্থান করতে থাকে।
ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন দানের পর হিলিতে ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর সঙ্গে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিকে হিলির মুহাড়া পাড়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাসহ মিত্র বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। এসময় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা শহীদ হন। পরবর্তীতে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মুহাড়া পাড়া এলাকাসহ পাক সেনাদের বিভিন্ন আস্তানায় আকাশ পথ ও স্থল পথে একসঙ্গে হামলা চালায়। দুই দিন যাবৎ প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাকহানাদার বাহিনী পরাস্থ হলে ১১ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের আওতায় দিনাজপুরের হিলি শত্রু মুক্ত হয়।