প্রসঙ্গ: দুর্গাদেবী ও দুর্গাপূজা এবং কিছু কথা
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০১৬, ২২:৫৫
প্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু মহাভারত মানুষের মুখে মুখে আসেনি। মহাভারতের ঘটনাটা আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছরের আগেরকার, কৃষ্ণের সময়কার। মহাভারত ও রামায়ণে তার উল্লেখ আছে, তা বাল্মীকি রামায়ণে নয়, তৎকালীন প্রচলিত রামায়ণের গল্প সমন্ধে যা মানুষের মুখে মুখে চলতো। বাল্মীকির রামায়ণের যে কাল সেই সময় মার্কন্ডেয় পুরাণের কাল আসেনি। মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবী দুর্গার কথা বলা হয়েছে। পৌরাণিক যুগে যখন শাক্তাচার শুরু হচ্ছে, মার্কন্ডেয় পুরাণ সেই সময়কার রচনা। সেই সময়ে দুর্গাদেবীকে কোথাও অষ্টভুজা আবার কোথাও দশভুজা বলা হয়েছে। তবে শেষ সমর্থন পায় দশভুজা। বাল্মীকির রামায়ণ যে সময়কার রচনা মার্কন্ডেয় পুরাণ সে সময় জন্মায়নি, দেবী দুর্গার আখ্যায়িকাও তখনও আসেনি। তাই বাল্মীকির রামায়ণে রাম দেবী দুর্গার পুজা করেছেন এক’শ আটটা নীলকমল দিয়ে, একটা কমল দেবী চুরি করলেন, এসবের উল্লেখ নেই।
এরপর এল মার্কন্ডেয় পুরাণ যুগ। যার ভিত্তিতে 'শ্রীশ্রীচন্ডী' লিখিত হয়েছে। পৌরাণিক শাক্তাচারের শক্তির আদিমতম অবস্থাকে সংস্কৃতিতে বলা হয় আদ্যাশক্তি। এই আদ্যাশক্তির চণ্ডীরূপই চণ্ডশক্তি বা চণ্ডী। তের’শ বছর আগের মার্কন্ডেয় পুরাণ, যার সংক্ষিপ্ত নাম চণ্ডী যাতে দুর্গাদেবীর কথা রয়েছে, সুরথ রাজার গল্প রয়েছে, তাতেও রামের কথা লেখা নেই, আর রাম যে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন সে গল্পও নেই। রাম কোন বাস্তব চরিত্র নয়, কল্পিত চরিত্র। একজন আর্দশ মানুষ কেমন হতে পারে তারই কল্পিত চরিত্র ও সেই চরিত্রকে যথাযথ রূপ দেবার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি।
মোঘল যুগের কবি তুলসীদাসের 'রামচরিতমানস'। সেখানেও রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার কোন উল্লেখ নেই।
তাহলে দুর্গাপূজার প্রচলন হলো কিভাবে???
পাঠান যুগের গোড়ার দিকে বরেন্দ্রভূমিতে- মানে, উত্তর বাংলার রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে কংসনারায়ন রায় নামে একজন রাজা ছিলেন। রাজা কংসনারায়নের প্রচুর টাকা- বিস্তীর্ন জমিদারী। তিনি তার সময়ের পন্ডিতদের ডেকে বললেন, "আমি রাজসূয় কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই। মানুষে জানুক আমার ধন ঐশ্বর্য কি রকম আছে, আর দুহাতে ফেলে ছড়িয়ে দান করব"। শুনে পন্ডিতেরা বলেছিলেন, "এই কলিযুগে রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ হয় না, তাই মার্কন্ডেয় পুরাণে যে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের কথা আছে, তাতেও খুব খরচ করা যায়, জাঁকজমক দেখানো যায়, নিজের ঐশ্বর্য দেখানো যায়। আপনি মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে এই দুর্গোৎসব করুন"। তখন রাজা কংসনারায়ন রায় তৎকালীন সাতলক্ষ স্বর্ণমূদ্রা ব্যয় করে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। তার দেখাদেখি একটাকিয়ার (একটাকিয়া সম্ভবতঃ রংপুর জেলায়) রাজা জগৎবল্লভ সারে আটলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে আরো জাঁকজমক করে দুর্গাপূজা করলেন। তাদের দেখদখি অন্যান্য জমিদাররা ভাবলেন, আমরাই বা কম কিসে, আমরাও টাকার খেলা দেখাতে পারি। তারাও জাঁকজমক করে দুর্গাপুজা শুরু করলেন। প্রতি জমিদার বাড়ীতে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপূজা। এইভাবে পূজাটা বাড়লো কিন্তু সবই ঘরের পূজা। সেই সময়ের হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ার (জায়গাটার আসল নাম গুপ্তবৃন্দাবন) বারো জন বন্ধু ভাবলেন যে আমরা একক ভাবে পারবো না, কিন্তু বারো জন মিলে তো পূজার আয়োজন করতে পারি। উর্দুভাষায় বন্ধু কে ইয়ার বলে, তাই বারো জন ইয়ারে মিলে যে দুর্গাপূজা করলেন সেটা হলো বারো ইয়ারি পূজা– বারোয়ারী পূজা। আর এই বারোয়ারী পূজায় যেহেতু অন্ত্যজ লোকদের অঞ্জলি দেবার অধিকার থাকে না, যাতে সবার অধিকার থাকে সেইজন্য অতি আধুনিক কালে বারোয়ারী পূজা বিবর্তিত হয়ে হলো সার্বজনীন পূজা।
পাঠান যুগের গোড়ার দিকে, তখন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ্, তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে যাতে ভাল ভাল বই লিখিত হয় ও সংস্কৃত ভাষার ভাল ভাল বইগুলো যাতে বাংলায় অনুদিত হয় সে জন্য তার প্রয়াসের অন্ত ছিলনা। তারই অনুরোধে কবি কৃত্তিবাস বাংলায় রামায়ণ লিখলেন। বাংলায় সে সময়ে জমিদার বাড়ীতে দুর্গাপূজা শুরু হয়ে গেছে। এই দুর্গাপূজাকে অধিকতর মহিমা দেবার জন্য কৃত্তিবাস তার বাংলা ভাষায় লেখা রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার উল্লেখ করেছিলেন। তাই রাম যে দুর্গাপূজা করেছে তার মূল সূত্র হল কৃত্তিবাসের রামায়ণ।
এই দুর্গাপূজা মুলতঃ অনুষ্ঠিত হয় মার্কণ্ডেয় পুরাণের ভিত্তিতে, দেবীপুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙিণী, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের ভিত্তিতে। এই গ্রন্থগুলো কোনটিই চৌদ্দ’শ বছরের পুরনো নয়। তার থেকে সুনির্বাচিত সাত’শটি শ্লোক নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মার্কন্ডেয় পুরাণ তৈরী হয়েছিল তাকেই বলা হয় ”দুর্গাশপ্তশতী”, কথ্য ভাষায় বলা হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী। অনেকে ভাবেন যে দুর্গা শিবের স্ত্রী, সাত হাজার বছর পূর্বের শিবের সাথে এই দুর্গাদেবীর কোন সম্পর্ক নেই। কোন যুক্তিতে বা কোন শাস্ত্রীয় নজিরে তা প্রমাণিত হচ্ছে না। তাছাড়া দুর্গাপূজা বেদসম্মত নয়। ঐদিকে বৈদিক পূজার ছাপ দেওয়ার জন্য বেদের দেবী সূক্তটির ব্যবহার করা হয় কিন্তু বেদের দেবীসূক্তে যে হৈমবতী উমার উল্লেখ আছে তার সঙ্গে দেবী দুর্গার কোন সম্পর্ক নেই।
লেখক: নারীবাদী সংগঠক ও লেখক