ইউরোপে সূর্যপূজো

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০১৭, ২১:০২

আতোয়ার রহমান

আগের অধ্যায়ের প্রাথমিক কথাগুলির পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সূর্যদেবতা আর তাঁদের পূজোর কিছু পরিচয় নেয়া যেতে পারে। স্বল্প পরিসরের রচনা বিস্তারিত পরিচয় লাভ অবশ্যি সম্ভব নয়। আমি তাই চেষ্টা করবো কেবল সংক্ষেপে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে ধরতে।

বয়ঃপ্রবীনতার বুনিয়াদে নয়, একালের পৃথিবীতে পরিচয়ের ব্যাপকতার কারণে, এখানে আমার আলোচনার প্রথম লক্ষ্য গ্রীসের এ্যাপোলো।

এ্যাপোলো
দেবরাজ জিয়ুস আর তাঁর পত্নী লেটোর পুত্র, এই এ্যাপোলা সম্পর্কে গ্রীক পুরাণের কথা, তাঁর জন্ম ডেলস (Delos) নামের এক দ্বীপে। তাঁর ভগিনী আর্টেমিসের সাথে একই গর্ভে। অর্থাৎ তিনি এবং আর্টেমিস যমজ ভ্রাতা-ভগ্নী। ডেলস থেকে তিনি হিযরত করেন পাইথোতে। জায়গাটি ছিলো সে এলাকার প্রহরায় রত নারী-ড্রাগন পাইথনের খান। তাকে হত্যা করে এ্যাপোলো হয়ে বসেন পাইথোর অধিদেবতা। তিনি পাইথোতে নামেন ডলফিনের ছদ্মবেশে, ক্রীটের একখানি জাহাজের নাবিকদের বশীভূত করে তার বুক থেকে লাফিয়ে পড়ে। গ্রীক ভাষায় ডলফিনের প্রতিশব্দ ‘ডেলফিস’ (Delphis)। তার থেকেই এ্যাপোলোর অধিকৃত পাইথোর নাম হয়ে যায় ডেলফি।

গ্রীক পুরাণ আরো বলে, এর আগে ক্রীটে আধিপ্ত ছিলো দেবী বসুমতীর (স্থানীয় ভাষায় নাম Ge)। কিন্তু এবার তাঁর জায়গা জুড়ে বসেন পাইথনের হন্তারক, এ্যাপোলো ডেলফিনিয়ুস (Apollo Delphinus) নাম নিয়ে। এদিকে, ডেলফির এ্যাপোলো মন্দিরই ক্রমে ক্রমে পরিনত হয় গ্রীসে তাঁর প্রধানতম পূজোমন্দিরে। এবং পরবর্তী কালে, গ্রীসের দেবলোক অলিম্পাসের (Olympus) সকল দেবদেবীকে ডিঙিয়ে, কেবল তিনিই স্বীকৃতি পান পরম গ্রীক দেবতা রূপে, যেমন চরিত্রে, তেমনি লীলাখেলায় আর প্রতিষ্ঠায়।

কিন্তু একালের পন্ডিতকুল তাঁর প্রতি বিরূপ। তাঁদের মতে, ঠিক ডেলস বা ডেলফি থেকে গ্রীসে তাঁর আধিপত্যের বিস্তার ঘটেনি। আসলে তিনি ওদেশে বহিরাগত। তাঁর জন্ম সম্ভবতঃ গ্রীসের প্রতিবেশী কোনো এশীয় দেশে। অথবা গ্রীসের উত্তরস্থ কোনো ভূখন্ডে।

তা-জন্ম তাঁর যেখানেই হোক, ঘটনাটি অনেক কাল আগের। তাঁর প্রভাব বিস্তারের অনেক বয়ান মেলে মহাকবি হোমারের আমল-খৃষ্ট-পূর্ব নবম শতক-থেকেই। পরে যদিও তিনি কিছু শিল্প এবং কূটনীতি আর ধনুর্বিদ্যার দেবতা, সেকালে তাঁর মরতবা ছিলো অনেক। মানুষ তখন তাঁরই কল্যানে অপরাধসচেতন হত এবং পাপ থেকে মুক্তি পেতো। তিনি সে-আমলে এক অলৌকিক দুরত্বে অবস্থান করেছেন আর সেখান থেকেই ভয় দেখিয়ে মানুষকে শাসনে রেখেছেন। ধর্মীয় আর সাংবিধানিক আইনে প্রধান অনুসরণীয় কন্ঠ ছিলো তাঁরই। অবতার আর দৈববাণীর মাধম্যে তিনি মানুষকে তাঁর ভবিষ্যৎজ্ঞান আর তাঁর পিতা জিয়ুসের আদেশ জানিয়ে দিতেন। তাঁর হাতের ধনুক তখন বিচ্ছিন্নতা, মৃত্যু, আতঙ্ক আর ভয়ে-ভরা বিস্ময়ের প্রতীক। দেবতারাও তাঁকে দেখেন ভয়ের চোখে। তাঁর উপস্থিতি সহনীয় কেবল তাঁর পিতা মাতার কাছে। শুধু তাঁর বীণা (lyre) দেয় এক মোহন ইঙ্গিত, কাব্য, সঙ্গীত আর নৃত্যের মাধ্যমে দেবলোকের সান্নিধ্য লাভের।

কোমলে কঠোরে মিশ্রিত এহেন এ্যাপোলোর খ্যাতি, স্বাভাবিক কারণেই, কেবল ডেলফিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন কালেই, খৃষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যেই, তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান ডেলফির সীমার বাইরে দূর দূর দেশে। এমনকি, লিডিয়া অবধি। সর্বত্রই তাঁর আদেশ-নির্দেশ প্রচারিত হত দৈববাণীর মাধ্যমে। যেগুলি ভক্তমহলে প্রচার করেছেন তাঁর মন্দিরের পুরুতরা, ছন্দিত ভাষ্য সহযোগে। আনাতোলিয়া, ডেলস আর মূল গ্রীক ভূখন্ডে তার মন্দির ছিলো অনেক। প্রধান মন্দিরস্থল ডেলফিতে তাঁর দৈববাণী প্রচারিত হত পাইথিয়া নান্মী পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়েসের এক মহিলার মাধ্যমে। এমনি মাধ্যম ছিলো তাঁর অন্যান্য মন্দিরেও।

সুদিনে এ্যাপোলোর নামে গ্রীসে নানারকম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলির একটি ছিলো ডেলফির স্টেপটারিয়ন (Stepterion)। এ-উৎসবে এ্যাপোলোর পাইথনবধ কাহিনী নাটকাকারে অভিনীত হত, নাটকে তাঁর ভুমিকায় কোনো কিশোরকে নামেয়। কৌতুহলের বিষয়, উৎসবের পর কিশোরগুলির ভাগ্যে জুটেছে টেম্পি উপত্যকায় (Vale of Tempe) সাময়িক নির্বাসন। উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত প্রতি আটবছরে একবার।

প্রসঙ্গতঃ আদ্যি কালে সূর্যদেব এ্যাপোলো পূজিত হয়েছেন একাধিক নামে। এটি সম্ভবতঃ তাঁর আগে পূজিত একাধিক সূর্যদেবতার তাঁর কাছে নতি স্বীকারের এবং ক্রমে তাঁর সাথে একাত্মতা লাভের ফল। অমঙ্গলবারণ (Averter of Evil) রূপে তাঁর নাম ছিলো আলেক্সিকাকস (Alexikakos)। এক্ষেত্রে তিনি রোগব্যাধি আর বন্য পশুর আক্রমণ রোধের দেবতা। তাঁর আর এক নাম তখন নোমিয়োস (Nomios) যার আক্ষরিক অর্থ ‘রাখাল’। অর্থাৎ এ-নামে তিনি আসলে পশুপালক সমাজের দেবতা। একদা তিনি যে পশুপালক সমাজে পূজো পেয়েছেন, তার প্রমাণ দেয় তাঁর আর এক নাম, লাইসিয়ুস (Lyceius)। তিনি এই নামটি নাকি পেয়েছিলেন নেকড়ের হাত থেকে মেষপালককে রক্ষা করতেন বলে। সন্দেহ নেই, নোমিয়োস আর লাইসিয়ুস আসলে পশুপালক সমাজের ফোলানো-ফাঁপানো মানুষ, ‘magnified man’. 

পশুপালক সমাজ ও সূর্যদেবতা
এ্যাপোলোর শেষোক্ত নাম দুটি থেকে কারো কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগবেঃ তাহলে পশুপালক সমাজেও সূর্যদেবতার আবির্ভাব ঘটতে পারে? কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?

সূর্যদেবতার জন্ম যে মানসভূমিতে, তার সন্ধার আমরা আগেই পেয়েছি। আসলে আলেক্সিকাকস, নোমিয়োস লাইসিয়ুসের মতো দেবতার জন্ম আদি কৃষিযুগের পরে, যখন কৃষিজীবী মানুষের ধ্যান-ধারণা বীরপূজক পশুপালকের মনেও সংক্রমিত হয়, দেবতা মানুষের আকারেও থাকতে পারেন, এই দর্শনের মাধ্যমে। এদিকে, একালে পরিচিত এ্যাপোলো নানাবিদ বিবর্তন আর শংমিশ্রণের ফল। যার এক প্রমাণ, আলেক্সিকাকস নামের এ্যাপোলো গোড়ায় ছিলেন, গ্রীক পুরাণেরই একাংশের মতে, ফসল এবং পশুপালের দেবতা। দ্বিতীয়তঃ তাঁকে এক কালে গ্রীসের অন্যতম সৌরদেবতা হেলিয়োসের সারথি রূপে দেখা গেছে। কিন্তু অর্বাচীন গ্রীক পুরাণে এ্যাপোলোই হয়ে যান সার্বভৌম সূর্যদেব।

এ্যাপোলোর এই বিবর্তন বাস্তবিকই বিচিত্র। মূল গ্রীক নাম ফীবাসের (Phoebus-সূর্য) মাধ্যমে এ-দেবতা গোড়ায় ছিলেন উজ্জলতা তথা নিস্কলুষতার নামান্তর। এবং সূর্যের সাথে জড়িত। অনেক পন্ডিতের অনুমান, তিনি মূলতইঃ আলোর দেবাতা। আর, খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে সূর্যদেবতা রূপে তাঁর পূজো ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপর রোম সাম্রাজ্যে, তিনি পূজো পেতে শুরু করেন অনির্জিত সূর্যদেব (Unconquered Sun) রূপে। 

এ্যাপোলোর রোমযাত্রা
অর্থাৎ তিনি ছিলেন রোমেরও সূর্যদেবতা। সেখানে তাঁর আবির্ভাব স্বাধীন-গ্রীসনিরপেক্ষ-ভাবে ঘটে কিনা, তা নৃবিজ্ঞানীরাই জানেন। আমরা কেবল দেখি, ইটালিতেও তাঁর পূজোর প্রচলন হয় প্রাচীন কালেই। এবং সেখানে আদিতে তিনি ছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রের দেবতা। তবে, সেই অবস্থান থেকে দৈববাণ করেছেন অবশ্যই। পরবর্তী কালে তিনি হয়ে ওঠেন চিত্রীমহলের এক প্রিয় দেবতা, সম্ভবতঃ গ্রসের প্রভাবে। এ-সময়ে চিত্রীদের হাতে তিনি রূপ পেয়েছেন এক সুদর্শন তরুণের। যিনি শ্মশ্রুহীন এবং প্রতীকে কখনো ধনুর্ধর, কখনো বীণাবাদক। আর, চিত্রিত কখনো লম্বা ঢিলে পোশাকে, কখনো বা জন্মদিনের স্যুটে। জনপ্রিয় ছিলেন তিনি এমনিতেও অভিজাত মহলে। খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ দিকে তাঁর এক বড়ো ভক্ত হয়ে দাড়ান রোমের সম্রাট অগাস্টাস। এই জনপ্রীতির ফল ব্যাপকভাবে তাঁর মন্দির আর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা। মূর্তিগুলি যেন তাঁকে তিলোত্তম পুরুষের রূপ দিয়ে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। ভ্যাটিকান প্রাসাদে রক্ষিত একটি মূর্তির প্রসঙ্গে কোনো পন্ডিত ব্যক্তির কথা, এ যেন মানবদেহের রূপমাধুর্যের চরম প্রকাশ। এ্যাপোলো ইটালিতে জনপ্রিয় ছিলেন অগাস্টাসের আমলের পরও। খৃস্টীয় প্রথম শতকের শেষ দিকে বিসুবিয়াসের অগ্নিবমনে বিলাঞ্ছিত পম্পেই নগরীর পুরতাত্ত্বিক খননকারীরা সেখানে সূর্যদেব এ্যাপোলোর এক সুদৃশ্য মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আবিস্কার করেছেন।

হেলিয়োস
এক দিকে গ্রীসের এই সূর্যদেবতার দিগ্বিজয়, এশিয়া আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রভুত্ব বিস্তার, অন্য দিকে সেদেশে আর এক সূর্যদেবের অন্ধকার বিস্মৃতিলোকে বিপতন। তাঁর নাম আগেই বলেছি, হেলিয়োস। একদা এ্যাপোলো ছিলেন তাঁর সারথি, একথা প্রমাণ দেয়, দেবত্বের এক পর্যায়ে তিনিই পান অজেয় সূর্যদেবের আসন। যদিও পুরাণাদিতেই ইঙ্গিত মেলে, দেবত্বের প্রায় আদি কাল থেকেই হেলিয়োস আর এ্যাপোলো ব্যাপকতম প্রতিষ্ঠা লাভের দৌড়ে হয়ে দাঁড়ান পরস্পরের অঘোষিত প্রতিযোগী। কিন্তু প্রাচীন কালের গ্রীকারা সম্ভবতঃ তাঁদের প্রতিযোগিতা ভালো চোখে দেখেননি, বরং দুজনকেই দিতে চেয়েছেন সমান মর্যাদা। আর, তাই তাঁদের পুরাণে দুজনে মাঝে মাঝে হয়ে যান অভিন্ন দেবতা।

এ-প্রসঙ্গে আর একবার স্মরণ করি, গ্রীসে এ্যাপোলোর প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে। ঠিক সেই সময়ে, যখন সেদেশে হেলিয়োস পূজিত হচ্ছেন অন্যতম প্রধান দেবাতা রূপে। এবং এক পর্যায়ে সূর্যবিষয়ক প্রায় সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে যায় তাঁর নাম। আগেই উল্লেখ করেছি, সূর্যপূজোর ইংরেজী প্রতিশব্দটি তাঁর নাম থেকেই অদ্ভুত। এক সময় মিশরের সূর্যপূজোর প্রধানতম কেন্দ্র ছিলো হেলিয়োপোলিস, সূর্যের শহর। অর্থাৎ সে-নামও হেলিয়োসজাত। এবং সিরিয়ার সূর্যপূজোর প্রধান কেন্দ্র বাল’বেক শহরও গ্রীকদের মুখে নাম পায় হেলিয়োপলিস।

গ্রীক পুরাণ মতে, হেলিয়োসের বাবার নাম হাইপারিয়ন, মায়ের নাম থিয়া। তিনি চার ঘোড়ার অগ্নিময় রথে চেপে পূর্ব থেকে পশ্চিম থেকে আকাশ পাড়ি দিতেন, ভগিনী ঊষাকে সামনে, রেখে রাত কাটাতেন। এক বিশাল পেয়ালায় চেপে সমুদ্রের উত্তর স্রোতধারা পরিক্রমা করে। গ্রীসে তিনি বিশেষভাবে পূজিত হয়েছেন রোডস দ্বীপে। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে তিনি প্রতিষ্ঠা পান সেখানকার প্রধান দেবতা রূপে। এবং তখন বলা হতে থাকে, তিনিই দ্বীপটির মালিক বা অধিপতি। গ্রীক পুরাণ আরো বলে, হেলিয়োসের পিতা হাইপারিয়ন নিজেও ছিলেন এক সূর্যদেবতা।

হেলিয়োসের প্রভাব-প্রতিপত্তির অবশ্যি এইখানেই শেষ নয়। এরপরও, এ্যাপোলোর মতোই, তাঁরও পূজো নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পন্ডিতদের অনুমান, এর জন্যে দায়ী একটি বিশেষ ব্যাপারঃ তাঁর প্রভাবের বেদীমূলে বেশ কিছু দেবতার আত্মসমর্পণ, তাঁদের আপন আপন পরিচয় আর প্রতিষ্ঠা বিসর্জন দিয়ে। (ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো, আমার ধারণায়, এ্যালোপোর প্রভুত্ব বিস্তারের কালেও।) তাঁদের আরো অনুমান, হেলিয়োসের এই জয়যাত্রার মূলে ছিলো প্রাচ্য দেশের কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস-সংস্কারের প্রভাব।

কিন্তু তারপর, কি কারণে, জানিনে, তিনি ক্রমে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। গ্রীক পূরাণের সূর্যদেবতা বলতে এখন লোকে এ্যাপোলোর কথা যতো শোনে, হেলিয়োস বা তাঁর অন্যান্য প্রতিপক্ষের কথা বোধ হয় তার শতাংশের এক অংশও শোনে না। এর কারণ কি? আমার ধারণা, এ্যাপোলোর মতোই তিনিও গ্রীসে ছিলেন বহিরাগত। তবে, এ্যাপোলো আসেন কাছের কোনো দেশ থেকে। আর হেলিয়োস ছিলেন দূরাগত। এ্যাপোলোর সাথে প্রতিযোগিতায় তাই তিনি গ্রীসে বেশী দিন টিকে থাকতে পারেননি। মিশরে হেলিয়োপলিস ছিলো সূর্যদেব রি বা রামের অতি প্রবল পূজোকেন্দ্র, যেমন ছিলো সিরিয়ার বা’লবেক শহর, সূর্যদেব বা’ল বা মারদুকের। হয়তো গ্রীকরা তাঁদের প্রভাবে পড়ে দুজনকেই আত্মীকৃত করে, তাদের স্বদেশজ পরিচয়ে-এবং এর আত্মীকরণের আরো জায়েজ রূপ দেয় দুটি শহরকেই তাদের ভাষায় হেলিয়োপলিস নাম দিয়ে, বা’ল এবং রামকে হেলিয়োস বলে ডাকবার পর। কিন্তু দূরদেশীর প্রতি আকর্ষণ বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। এ-সম্পর্কে আরো আলোচনা যথাস্থানে।

সূর্যের রথ
তার আগে এখানে আর একটি কথা। একটু আগেই দেখছিলাম, সূর্যদেব হেলিয়োস আকাশ পরিক্রমায় বেরুতেন আশ্বচালিত রথে চেপে। রথের এমন ব্যবহার অবশ্যি তাঁর একচেটিয়া ছিলো না। অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করেছেন পৃথিবীর আরো অনেক দেশের সূর্যদেবতাই। যাঁদের এক প্রতিনিধি বারতের সূর্যদেব। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নরওয়ের ধর্মীয় সমাজের অধীশ্বর ছিলেন যে সূর্যদেবতা, তাঁরও বাহন ছিলো অশ্বচালিত রথ।

তা-সূর্যদেবেরা এই রথ পেলেন কোথা থেকে?

লোককৃতি তো মানুষের জীবন আর পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত ধ্যান-ধারণার ফল। এই সূত্রের বুনিয়াদে ধরে নেয়া যেতে পারে, অশ্বচালিত রথের সাথে যাদের জীবন জড়িত ছিলো, সূর্যদেবকে রথে বসিয়েছেন তারাই। এবং তারা পালিত অশ্বের মালিক হিসেবে পশুপালক সমাজের মানুষ। কিন্তু পশুপালক সমাজ স্বাধীনভাবে কোনো দেবতার জন্ম দেয়নি। কেননা, মানুষ কখনোই কেবল পশুপালক (বা শিকারী) ছিলো না। এখানে তাই আমার আগের একটি কথা আবার বলি, পশুপালক সমাজে সূর্যদেবতা আসন জুড়ে বসেছিলেন তাদের কৃষিজীবী সমাজ বা তার দ্বারা প্রভাবিত জীবন থেকে এসে। এবং পন্ডিতদের রায়, পশুপালকরা যখন তাদের মূল বাসভূমি (তৃনাঞ্চল) থেকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের সূর্যদেবও সাথে সাথে ফিরতে থাকেন অশ্বচালিত রথে চেপে। রথারূঢ় সূর্যদেবতার পূজো এভাবেই বিস্তার লাভ করে। আর, এটা ঘটে বিশেষভাবে ব্রোঞ্জ যুগে। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিনামা পুরাতত্ত্ববিদ জেফ্রি বিবির (Geofrey Bibby) প্রায় এমনি একটি কথা স্মরণীয়। তিনি লিখছেন-

The association of the sun with horse chariot points unmistakably to the battle-axe charioteers as the bearer of this religion (অর্থাৎ সূর্যপূজো), and the evidence of sun worship mounts steadily through the great period to the Broze Age…

তবে, রথপতিরা যে রব ক্ষেত্রেই তাদের মূল বাসভূমি থেকে সূর্যদেবতাকে সাথে নিয়ে বেরোয়, তা নয়। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল বাসভূমির দেবতা তাদের সাথে হিজরত বা প্রভাববলয় বিস্তার করেন। কিন্তু কোনো কোনো সময় রথপতিদের নতুন বাসভূমির দেবতাও দাতের সমাজে পূজোর অধিকার লাভ করেছেন এবং সেই সুবাদে উঠে বসেছেন তাদের রথে। মানবসমাজে সংস্কার-বিশ্বাসের লেনদেনতো নতুন কিছু নয়। এক গোষ্ঠীর সংস্কার-বিশ্বাস অন্য গোষ্ঠীতে সংক্রামিত হতে পারে, বস্তুতঃ হয়েছেও অতি সহজেই। মূলত সেই পরিস্থিতিতে, যখন একের সংস্কার-বিশ্বাস থাকে অন্যের সংস্কার-বিশ্বাস থেকে প্রবল অথবা যখন তাদের আর্থসামাজিক শক্তি থাকে অন্যের সেই শক্তির চেয়ে বেশী।

স্ক্যাডিনেভিয়ার সূর্যপূজো
এখন, কথা উঠেছিলো সূর্যদেবতার রথ নিয়ে। এবং সেই সূত্রে উদাহরণ হিসেবে কথা আসে নরওয়ের সূর্যদেবতার। যদিও বিশেষ কোনো নামে নয়। তা নামের তত্ত্ব এই আলোচনায় বাদ থাক, তাঁর কিছু পরিচয় যদি এমনিই জেনে নেই, তিনি রুস্ট হবেন না নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, একদা, আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রকের মাঝামাঝি সময়ে নরওয়ে-সুইডেন তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্য। এবং তাই অতি ব্যাপকভাবে পূজিত। সেখানে যখন তাঁর পূজোর ব্যাপক প্রসার ঘটে, অঞ্চলটি তখনও কেবল অংশতঃ কৃষিজীবী, প্রধানতঃ যবচাষী। তার সে যুগের সবচেয়ে বড়ো জীবিকা মাছ ধরা। তবু শস্যের দেবতা সূর্যই নিয়ন্ত্রণ করেন তার সকল কাজ, হয়তো মূল জীবিকার দেবতা রূপে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানুষ তাই তখন মাছ ধরতে বেরিয়েও তাঁর কথা ভূলতে পারেনি। নৌকোয় দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্দেশে হাত তুলে নিবেদন করেছে যবের দানা।

কিন্তু সে-আমলের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সূর্যপূজোর এ কেবল একটি দিক। আর, অতি সামান্য এবং আনুষ্ঠানিকতায় অতি দীন। তার আনুষ্ঠানিকতা প্রকাশ পেতো মন্দিরে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত থাকতো সৌরদেবতার রথের কাঠে-তৈরী প্রতিমা। সে আমলে তাঁর পূজো হয়েছে প্রধানতঃ বছরের চারটি উৎসবকালে। উল্লেখ্য, সব কটি উৎসবই ছিলো কৃষিকেন্দ্রিক। প্রথমটি অনুষ্ঠিত হত বোনাবুনির মওসুমে, বলার অপেক্ষা রাখে না, বসন্তকালে যখন দিনরাত্রির দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। উৎসবের দিনে তাঁর রথপ্রতিমা বাইরে এসেছে ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে চেপে। সেই গাড়ী ঘুরে বেড়াতো ফসলের মাঠ থেকে মাঠে, নতুন গজানো বার্চ পাতার মালা পরা পুরুত মশাই আর তাঁর সেবকদের নিয়ে। পুরুত আর তাঁর সেবকদের মন্ত্রগান শুনতে শুনতে তাঁদের অনুসরণ করেছে নারী-পুরুষ-শিশুর দল। প্রতিমাবাহী শকটের যাত্রা শেষ হত কিছু বলিদানের পর, আনুষ্ঠানিকভাবে হল চালনার সূচনা দিয়ে।

দ্বিতীয় উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত গৃস্মকালের মাঝামাঝি সময়ে। বলিদানের আয়োজন সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে তৃতীয় উৎসবে, যেটি মূলতঃ ছিলো নবান্নের। এ-সময়ে বলি দেওয়া হত গরু, ছাগল, ভেড়া এবং শুয়োর। মন্দির প্রাঙ্গণে রক্ষিত ফলকে ফসলের জন্যে সূর্যদেবতার উদ্দেশে শুকরিয়া জানিয়ে।

এই সূর্যদেবতার নাম যা-ই হোক, তাঁর পূরাণ বহুশ্রুত নয়। তাঁর এক প্রতিদ্বন্দীর কথা নরওয়ের পুরাণ-কাহিনীর মাধ্যমে আজও লোককৃতি গবেষকদের মন কাড়ে। এই প্রতিদ্বন্দী ছদ্মবেশী সূর্যদেবতা। তাঁর নাম বলডার (Balder)। পুরাণ বলে, তিনি ছিলেন আলোর দেবতা, দেবলোক আসগার্ডের রাজা ওডিন আর রানী ফ্রিয়ার বহু সন্তানের অন্যতম। অতি জনপ্রিয় এই দেবতা শেষ অবধি দেবলোকের এক নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে নিহত হন। কিন্তু এটা আমাদের কাছে বড়ো কথা নয়। বড়ো কথাঃ তিনি আসলে সূর্যদেবতা। প্রাচীন ইরানের আহুর মাজদাও মূলে আলোর দেবতা, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেছেন সূর্য এবং আগুনের রূপে।

নরওয়ে-সুইডেনের এক প্রতিবেশী দেশ ডেনমার্ক। ব্রোঞ্জ যুগে, ইউরোপের মূল ভূখন্ডের আর সব এলাকার মতোই, এই দেশটি ছিলো ঘোর সূর্যপুজোক। এবং নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেকালের ডেনমার্কবাসীরা পূজো করতো সূর্যমন্ডল বানিয়ে (sun-dics)। তাদের দেশেও সূর্যদেবের বাহন ছিলো ঘোড়ায় টানা গাড়ী। উত্তর জীল্যান্ডের ট্রুন্ডহোল্ম (Trundholm) থেকে সংগৃহীত একটি পুরাকীতি সংরক্ষিত রয়েছে ডেনমার্কের জাতীয় জাদুঘরে। সে-কীর্তিতে সোনায় মোড়া সূর্যমন্ডলটি ছয় চাকার এক গাড়ীতে স্থাপিত। এবং কৌতুহলের বিষয়, তার চালক ঘোড়াটিও দাঁড়িয়ে আছে গাড়ীতেই, সূর্যমন্ডলের ঠিক সামনে। মূলে সূর্যমন্ডল তৈরী ব্রোঞ্জে।

স্টোনহেঞ্জঃ যুক্তরাজ্য
সূর্যদেবের মন্দিরে মন্দিরে আকীর্ণ মূল ইউরোপ ভূখন্ড থেকে এবার চোখ ফেরানো যায় অন্য দিকে। এ-কারণে যে, সেখানে সূর্যপূজোর ধরন ছিলো একটু ভিন্ন। যতো দূর জানি, সেখানে খাস করে সূর্যদেবের নামে কোনো মন্দির নির্মিত হয়নি-কিংবা তাঁর তেমন কোন বিগ্রহও।

যায়গাটি বর্তমান যুক্তরাজ্যের মধ্য ভাগে, টেমস নদীর উত্তর দিকের অববাহিকায়। সেখানকার মানুষ মৃতদেহের সৎকার করতো বিশেষভাবে তৈরী সমাধিতে। সেই সমাধির এক-একটি গর্তে বসানো হয়েছে বিশাল বিশাল পাথরের থাম, এখন যেগুলির পরিচয় স্টোনহেঞ্জ বলে। তার স্থাপনকৌশল এমনি ছিলো যে, সূর্যদয়ের সময় তার ছায়া গিয়ে পড়তো জিনিষটির পশ্চিম দিকে দাঁড়ানো পুরুত ঠাকুরের ঠিক পায়ের কাছে। স্টোনহেঞ্জ তার নির্মাতা সমাজের সূর্যপূজোর প্রধান স্থান, যদিও নৃবিজ্ঞানীদের মতে, প্রথম দিকে এই স্থাপত্যটি ছিলো উর্বরতাবাদের প্রতিক। কালক্রমে স্টোনহেঞ্জ হয়ে ওঠে সারা ইংল্যান্ডের এবং সেই সঙ্গে উত্তর ইউরোপের অনেক দেশেরও-মানুষের কাছে এক বিরাট তীর্থভূমি, তাদের সূর্যপূজোর সকল স্থানের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের দিকে, সমকালীন মিশরীয় দেবমন্দিরের স্থাপত্যরীতির প্রভাবে, স্টোনহেঞ্জ নতুন রূপ পায়। এর মূলে ছিলেন ইংল্যান্ডের ধনী পুরোহিত সমাজ আর রাজন্যকুল।

(চলবে)

পড়ুন ১ম পর্ব
সূর্যবাদ: প্রণতোহস্মি দিবাকরম্

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী
এই গ্রন্থের তথ্যাবলীর জন্যে কয়েকখানি সুপরিচিত বিশ্বকোষ তথা অল্পপরিচিত অভিধান ছাড়াও ব্যবহৃত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে গ্রাহ্য-
১। পাকিস্তানের উপজাতি-পাকিস্তান পাবলিকেশানস, ১৯৬৩
২। পৃথিবীর ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ-ফিওদর কারাভকিন; প্রগতি প্রকাশন, মস্কোঃ ১৯৮০
৩। প্রতীচ্য পুরাণ-ফরহাদ খান; বাংলা একাডেমী, ঢাকা-১৯৮৪
৪। ব্রক্ষ্মাগুপুরাণ
৫। ভারতীয় দর্শন (প্রথম খন্ড)-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা-১৯৬৫
৬। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়-অক্ষয়কুমার দত্ত; করুণা প্রকাশণী সংস্করণ, কলকাতা-১৯৮৭
৭। Asian Culture-no. 31-The Asian Culture Centre for UNESCO Tokyo; Spring-1982.
৮। Aztecs of Mexico-G. C. Vaillant; Pelican Book-1965
৯। Egyptian Wall Paintings-Christiane Desrochec-Novlecourt; Collins, Milan, Italy-1962
১০। Four Thousand Years Ago-Geoffry Bibby; Penguin Books-1965
১১। Lost Cities and Vanished Civilization-Robert Silvelberg; Bantam Book, New York-1963
১২। Man Makes Himself-V. Gordon Childe ; Penguin Book-1962
১৩। The Ancient world-Bhagawat Saran Upadhyaya: The Institute of Asian studies, Hyderabad, India-1954
১৪। The Growth of Civilisation-W.J. Perry; Pelican Books-1937
১৫। The Origins of Oriental Civilisation-Walter A. Fairservis, jr:, The New English Library; London: 4th printing-1959
১৬। What Happened in History? Gordon Childe; Penguin book-1962.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত