ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে মেরিলের জ্বালাময়ী বক্তৃতা
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:২৩
গত রবিবার রাতে হলিউড ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে ৭৪তম গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠিত হয়, যাতে এবার বিশেষ সম্মাননা হিসেবে ‘সেসিল বি ডেমিলে অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন হলিউড অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। তবে এই সম্মাননার চেয়েও বড় খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে মঞ্চে উঠে অনুভূতি প্রকাশের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে মেরিল এর জ্বালাময়ী বক্তব্য। কোনো নাম প্রকাশ না করলেও মেরিল এর কথার রেশেই বুঝা যায় নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করেই ছিল তার প্রতিটি কথা।
তবে চুপ করে বসে থাকেননি ডোনাল্ড ট্রাম্পও। মেরিলের বক্তব্যের পরপরই নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন তিনি। বছরখানেক আগে মেরিল স্ট্রিপকে একটি সাক্ষাৎকারে সময়ের সেরা শিল্পী হিসেবে আখ্যা দিলেও এই ঘটনার পর ট্রাম্প সরাসরি স্ট্রিপকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রী নাকি অতিমূল্যায়িত (ওভাররেটেড) একজন তারকা এবং ‘হিলারিপন্থী’।
কিন্তু কি ছিল মেরিলের সেই বক্তব্যে যার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন হলিউডের সব নামীদামী তারকারাও? পাঠকদের জন্য মেরিলের সেই সাহসী বক্তব্য এখানে তুলে দেয়া হলো।
ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সবাইকে। তোমাদের সবাইকে আমি খুব ভালোবাসি। তবে শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই সপ্তাহে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে গিয়ে আমি গলার স্বর নষ্ট করে ফেলেছি। আর এ বছরের শুরুর দিকে আমি আমার মাথাটাও নষ্ট করে ফেলেছি। তাই এখন আমার বক্তব্য দেখে দেখে পড়তে হবে।
হলিউড ফরেন প্রেসকে ধন্যবাদ। হিউ লরির কথা ধরেই বলি, এখন এই মিলনায়তনে বসা আমরা সবাই আমেরিকার সবচেয়ে বিতর্কিত শ্রেণির মানুষ। ভেবে দেখুন, একবার ‘হলিউড’, ‘ফরেন’, ‘প্রেস’! কিন্তু আমরা আসলে কারা? আর এই হলিউডই বা কী? জানেন কেউ? হলিউড হলো নানা স্থান থেকে আসা একদল মানুষের মিলনস্থল।
এই যেমন আমি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিউ জার্সিতে। ভায়োলার (ডেভিস) জন্ম সাউথ ক্যারোলাইনা, বেড়ে ওঠা রড আইল্যান্ডের সেন্ট্রাল ফলসে। সারাহ পলসন একা মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেছেন ব্রুকলিনে। সারাহ জেসিকা পার্কার সাত কিংবা আট ভাইবোনের সঙ্গে ওহাইওতে বড় হয়েছেন। অ্যামি অ্যাডামসের জন্ম ইতালিতে। নাটালি পোর্টম্যান জেরুজালেমের। তাদের জন্মনিবন্ধনপত্র দেখেছেন তো? সুন্দরী রুথ নেগারের জন্মস্থান ইথিওপিয়া, বেড়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডে। রায়ান গসলিং, আর সব সুদর্শন মানুষের মতো তিনিও কানাডার। এবং দেব পাটেল, জন্মেছেন কেনিয়ায়, বেড়ে উঠেছেন লন্ডনে, এখানে (হলিউডে) আছেন একজন ভারতীয়র চরিত্রে অভিনয় করে। বহিরাগতদের ভিড়ে গিজগিজ করছে হলিউড। আপনি যদি সবাইকে বের করে দেন, তাহলে দেখার মতো আর কিছুই থাকবে না; তখন ফুটবল আর মিক্সড মার্শাল আর্টসই দেখতে হবে, যা আসলে কোনো শিল্প নয়। অভিনেতার একমাত্র কাজ হচ্ছে নিজের থেকে ভিন্ন একজনের জীবনকে অভিনয় দিয়ে সবার সামনে তুলে ধরা, সবাইকে এটা অনুভব করানো যে সেই জীবনটা আসলে কেমন। এ বছর এমন অনেক অসাধারণ কিছু জীবনের গল্প অভিনেতারা পর্দায় তুলে ধরেছিলেন নিজেদের দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে।
তবে এ বছর এমন একটি অভিনয় ছিল যা আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল। আমার হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধেছিল সেই অভিনয়। তাতে ভালো কিছু ছিল বলে নয়, সেই অভিনয়ে আসলে ভালো কিছুই ছিল না। সেটা ছিল যন্ত্রণাদায়ক এবং সেটা আমাকে যন্ত্রণাই দিয়েছে। এটা নির্দিষ্টসংখ্যক কিছু দর্শককে বিনোদিত করেছে, বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। আমি সেই অভিনয়ের কথা বলছি, যে অভিনয়টি করেছেন সেই ব্যক্তি, যাকে আমরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদে বসিয়েছি। তিনি এমন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী রিপোর্টারের অক্ষমতাকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে অভিনয় করে দেখিয়েছেন, যে রিপোর্টার আসলে ক্ষমতাধর সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনোদিন প্রতিবাদ করতে পারবেন না। আমি যখন এটা দেখি, আমার হৃদয়টা তখন ভেঙে যায়। আমি এখনো আমার মাথা থেকে বিষয়টি বের করতে পারিনি। কারণ এটা কোনো সিনেমা ছিল না, এটা ছিল সত্যিকারের ঘটনা।
ব্যঙ্গাত্মক ও অপমানজনক এমন কাণ্ড দেশের কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে করলে তা এই বার্তাই দেয় যে, এমন গর্হিত ঘটনা দেশের যে কেউই করতে পারে। অসম্মানের বদলে অসম্মানই করা হয় তখন। হিংসা বয়ে আনে হিংসা। ক্ষমতাধরেরা অন্যকে আঘাতের জন্য ক্ষমতার ব্যবহার করলে হেরে যায় দেশ, হেরে যাই আমরা সবাই।
এ কথার রেশ ধরেই গণমাধ্যমের প্রসঙ্গে আসতে চাই। আমরা চাই গণমাধ্যমের নীতি এমন হোক যেন এর কাছে দেশের সর্বোচ্চ শক্তিও জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। এ জন্যই তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা সংবিধানে গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই আমি অনুরোধ করব, সুপ্রতিষ্ঠিত হলিউড ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন ও আমার অঙ্গনের প্রত্যেককে আমার সঙ্গে একাত্ম হতে। সুসাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখার ও সাংবাদিকদের রক্ষা করার আন্দোলনে সবাইকে এক হওয়ার অনুরোধ করব। কারণ এ সময়ে সাংবাদিকদের পথ মসৃণ করার জন্য আমাদের সহযোগিতা করতে হবে, যেন তারা আমাদের সত্যকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
আরও একটি বিষয়ে বলতে চাই। একদিন আমরা রাতের খাওয়ার আগে শুটিং সেটে দাঁড়িয়েছিলাম। খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুটিং করতে হবে ভেবে আক্ষেপ করছিলাম। সে সময়ই অভিনেতা টমি লি জোনস আমাকে বললেন, ‘মেরিল, অভিনেতা হওয়াই তো একটি বিশেষ অর্জন, তাই না?’ সত্যিই তাই। এ এক বিশেষ অর্জন। আর এটাই আমাদের একে অপরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে হবে—এটা এক বিশেষ অর্জন এবং একটি বিশেষ দায়িত্বও। আমাদের সবার গর্বিত হওয়া উচিত যে হলিউড আমাদের আজকের মতো একটি রাত উপহার দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে।
আমার প্রয়াত বন্ধু প্রিন্সেস লিয়া একবার আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, সেটা দিয়েই শেষ করব। শিল্প সৃষ্টি হোক তোমার ভাঙা হৃদয় দিয়েই। ধন্যবাদ।
মেরিলের এই বক্তৃতার পর থেকেই এ নিয়ে শুরু হয়েছে দারুণ হৈ চৈ। তবে অধিকাংশ হলিউড তারকারাই মেরিলের এই সাহসিকতার প্রশংসা করে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।