এসো পা বাড়াই (৪র্থ পর্ব)

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:১৩

"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"

LEAN IN                                                                 এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD         নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG                           অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি

২০১১ সালে লেইমা গোয়ী (Leymah Gbowee) নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন, লাইবেরিয়ার স্বৈরশাসক উৎখাতে নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তিনি তার আত্মজীবনী লিখেছেন, "Mighty Be Our Powers” নামে। তার নোবেল জয়ের আগের দিন রাতে আমার বাসায় তার বইয়ের প্রকাশনা উৎসব উদযাপন করছিলাম। সে রাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মন খারাপ করা অনেক আলোচনাও হয়েছিল। একজন অতিথি তার কাছে জানতে চাইছিল, লাইবেরিয়ার মত যুদ্ধে যেসব নারীরা ভয়াবহ গণধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদেরকে আমেরিকান নারীরা কিভাবে সাহায্য করতে পারে? তার ছোট্ট সাধারণ উত্তর ছিল, "আরো বেশি নারী ক্ষমতায় আসতে হবে"। যদিও আমি এবং লেইমা (Leymah) ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছি তবুও আমরা একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, নারীরা যত বেশী নেতৃত্বের ভুমিকায় আসবে ততই সমস্ত নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে। নেতৃত্বে থাকা নারীরাই নারীদের চাহিদা এবং উদ্বেগ এর ক্ষেত্রে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ ভাবে কথা বলতে পারবে।

এখন সুস্পষ্ট প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে? কিভাবে আমরা বেশী বেশী নারীদের শীর্ষে ওঠার প্রতিবন্ধকতাকে কমিয়ে আনতে পারি? পেশাগত জীবনে নারীরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে স্থুল ও সূক্ষ্ম লিঙ্গ বৈষম্য এবং যৌন হয়রানি অন্যতম। এছাড়া খুবই অল্প সংখ্যক কাজের জায়গা থেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটি অথবা শিশুসেবা কেন্দ্রের সুবিধা পাওয়া যায়। অথবা নিজের সুবিধামত কাজের সময় ঠিক করে নেয়া, সেটাও খুবই কম সংখ্যক অফিস থেকেই পাওয়া যায়। অথচ সন্তানকে ভালোভাবে মানুষ করার পাশাপাশি কর্মজীবন চালিয়ে নেয়ার জন্য এগুলো খুবই প্রয়োজনীয়। আবার পুরুষরা খুব সহজেই কর্মজীবনের অমুল্য উপাদান মেনটোর এবং স্পন্সর খুঁজে পায়, যেখানে এর জন্য নারীদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে অনেক বেশী খাটতে হয়। এটা শুধু আমাদের মুখের কথা নয়। ২০১১ সালের ম্যাকিনজি (McKinsey) প্রতিবেদনে প্রকাশিত যে, পুরুষদের পদোন্নতি দেয়া হয় ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বিবেচনা করে, যেখানে নারীদের পদোন্নতি নির্ভর করে তাদের অতীত অর্জনের উপর।

সমাজের তৈরী বাইরের এই যে বাধার প্রাচীর এর সাথে নারীদের নিজেদের ভেতরেও রয়েছে পশ্চাদপদতার প্রবনতা। ছোট বড় নানা উপায়ে আমরা নিজেদেরকে পেছনে ফেলে রাখি, এর মধ্যে রয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, প্রয়োজনের সময় মুখ না খোলা। যখন আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত তখন আমরা নিজেদের পেছনে টেনে রাখি। সারাজীবন ধরে পাওয়া নেতিবাচক বার্তা গুলো আমরা আমাদের ভেতরে ধারণ করি। সেই সব বার্তা যা বলে- স্পষ্টবাদী, অদম্য কিংবা পুরুষের চেয়ে বেশী ক্ষমতাশালী হওয়াটা ভুল। যা আমরা অর্জন করতে পারি, সে ক্ষেত্রেও আমরা নিজেদের প্রত্যাশা কমিয়ে রাখি। সন্তানের যত্ন নেয়া থেকে বেশীরভাগ ঘরের কাজ আমরা করে যেতে থাকি। সন্তান এবং সঙ্গীর কথা বিবেচনা করে নতুন জীবন শুরুর অনেক আগে থেকেই কর্মজীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে আমরা আপস করি। পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় আমাদের খুব অল্প জনেরই তীব্র কামনা থাকে শীর্ষ পদে যাওয়ার। এগুলো শুধু অন্য নারীদের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, এ প্রত্যেকটা ভুল আমি নিজেও করেছি। মাঝে মাঝে আমি এখনও করি। আমার যুক্তিতে ক্ষমতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের আভ্যন্তরীণ বাধাগুলো দূর করা। অন্য অনেকে যুক্তি দেখায় যে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বাধাগুলো দূর হলেই নারীরা শীর্ষে যেতে পারবে। এটা শেষ পর্যন্ত 'ডিম আগে না মুরগী আগে' -সেই তর্কের মত অবস্থা হয়। 

মুরগী: নেতৃত্ব অর্জন করে নারীরা বাইরের বাধাগুলো ভেঙ্গে ফেলবে। আমরা তখন দৃপ্তপায়ে বসের অফিসে গিয়ে প্রেগনেন্সি পার্কিং সহ আমাদের প্রয়োজনীয় দাবী জানাতে পারবো। অথবা এটাও উত্তম যে, নিজেরাই বস হয়ে যাওয়া এবং নারীদের প্রয়োজনীয়তাগুলো নিশ্চিতভাবে পূরণ করা। 
ডিম: আমাদের ঐ সব ভূমিকায় যেতে প্রথমেই বাইরের বাধা গুলোকে দূর করা প্রয়োজন। 

উভয় পক্ষই সঠিক, তাই কোনটা আগে, এই দার্শনিক তর্কে সময় নষ্ট না করে আমরা একমত হই দুই পক্ষকেই গুরুত্ব দিতে। তারা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেসব নারীদের উৎসাহ দেই যারা মুরগীতে মনোযোগ দিয়েছে কিন্তু আমি তাদেরও পুরোপুরি সমর্থন করি যারা ডিম এ মনোযোগ দিতে চায়।

(চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত