‘বস্তার আরও পিছনের দিকে হাঁটছে’
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০২:৪৪
দীর্ঘকাল বস্তারের উপর গবেষণা চালাচ্ছেন সমাজতাত্ত্বিক নন্দিনী সুন্দর। তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ বস্তার নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। নয়াদিল্লিতে তাঁর মুখোমুখি রিমি মুৎসুদ্দি।
প্রশ্ন: আপনার বই ‘দ্য বার্নিং ফরেস্ট/ইন্ডিয়া’জ ওয়ার ইন বস্তার’-এ আপনি লিখেছেন, ‘যুদ্ধ আগেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, যদিও আমি তা আগে বুঝতে পারিনি।’ এখানে যুদ্ধ বলতে আপনি রাষ্ট্র বনাম মাওবাদীদের যুদ্ধের কথাই বলেছেন?
উত্তর: হ্যাঁ, ছত্তীসগঢ়, বস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ বলতে আপাতদৃষ্টিতে মাওবাদী বনাম রাষ্ট্রই বোঝায়। এই যুদ্ধ, কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছিল সেই আশির দশক থেকে। তবে যুদ্ধটা এখন আর শুধু মাওবাদী ও রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মাওবাদীদের প্রতি রাষ্ট্রের দমননীতি এখন কেবলমাত্র বস্তারের আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো ‘স্পেশাল পুলিশ অফিসারস ইন অ্যান্টি নকশাল অপারেশন’ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
উত্তর: হ্যাঁ, সুপ্রিম কোর্ট ব্যান করেছে। কিন্তু ছত্তীসগঢ় সরকার ক্রমাগত সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করে চলেছে। এই আদেশের ফলস্বরূপ তারা ‘স্পেশাল পুলিশ অফিসারস’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘আর্মড অক্সিলারি ফোর্সেস’ রেখেছে। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে নিরস্ত্রীকরণের নীতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেখানে রাজ্য সরকার ক্রমাগত এই আর্মড অক্সিলারি ফোর্সকে আরও বেশি করে বন্দুক ও টাকার যোগান দিয়ে চলেছে।
প্রশ্ন: সালওয়া জুড়ুম আইনত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এর ফলে বস্তারের আদিবাসীরা কি একটু স্বস্তিতে নেই?
উত্তর: দেখুন, সালওয়া জুড়ুম শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে। ২০০৭-এর মধ্যেই টিমাপুরম, মোরপল্লি, টারমেটলা— এই গ্রামগুলি মিলিয়ে প্রায় ৩০০ ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধর্ষণ আর খুনের পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। এর পর ২০০৯–এ অপারেশন গ্রিন হান্ট শুরুর পর থেকে আদিবাসীরা আরও চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে থাকে। কত গ্রাম যে ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে তার হিসেব রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানে পাবেন না। ২০১১-তে সালওয়া জুড়ুম নিষিদ্ধ হয়। সেই বছরই জুলাই মাসে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে একটা অভিযানে বস্তারের প্রায় চারটি গ্রামই একেবারে ‘নেই’ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: ২০১১-র পর চিত্রটা কি কিছুটা বদলেছে?
উত্তর: সালওয়া জুড়ুম আইনত বন্ধ হলেও আদিবাসীরা কোন স্বস্তি পায়নি। সালওয়া জুড়ুম-এর রূপ পরিবর্তন হয়েছে। পুলিশ ও কিছু রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী মিলে মাওবাদী দমনের জন্য কয়েকটা ফোরাম তৈরি করেছে। এগুলো হল অগ্নি, সামাজিক একতা মঞ্চ ইত্যাদি। এরা মাওবাদী দমনের নামে আদিবাসীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ আর ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া তো এখানে প্রতি দিনের ঘটনা। যে আদিবাসী মেয়েটা সকালে মহুয়া কুড়োতে যাচ্ছে, দুপুরে তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। খাঁকি পোশাক পরা সেই মৃতদেহ দেখিয়ে একদল উল্লাস করে বলছে, গেরিলা স্কোয়াডের কমান্ডার পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আবার পুলিশের সমর্থনে থাকা গ্রামবাসীরাও মাওবাদীদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনার বইতে পরিসংখ্যানগত তথ্য ও গ্রামবাসীদের উপর হওয়া অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে কি আপনার মনে হয় বস্তারের কথা সারা দেশে ও বিশ্বের দরবারে পৌঁছবে? বিচার পাবে অত্যাচারিত গ্রামবাসীরা?
উত্তর: আশা রাখছি। মানুষের কাছে পৌঁছে যাক এই আর্তকাহিনি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, কল্যাণকামী রাষ্ট্র এগিয়ে আসুক। নৃতাত্ত্বিক ভাবে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল ও তার ভূমিপুত্রেরা বিচার পাক। তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত হোক।
প্রশ্ন: আপনি প্রথম কবে বস্তারে এসেছিলেন?
উত্তর: আমি তখন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অ্যানথ্রোপলজিতে পিএইচডি করছিলাম। আমার বিষয় ছিল: সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ অ্যান্ড কলোনিয়াল রিবেল। ১৯৯০ সালে আমি যখন এই অঞ্চল সম্বন্ধে পড়াশোনা করছিলাম সেই সময়ে আমার ধারণা ছিল, এখানে এই ধরনের কোনও লড়াই শুরু হয়নি। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু মহম্মদ ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী কলা আমাকে এখানে আসতে অনুরোধ করে। ইকবাল আর কলার গল্পও কিছুটা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নাগপুরের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইকবাল বস্তারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ও এক আদিবাসী মেয়ের প্রেমে পড়ে এখানেই সারাজীবন থেকে যায়। ইকবাল ও কলার এই পথ চলা মোটেই মসৃণ ছিল না। যাই হোক, আমি ওদের আমন্ত্রণেই প্রথম এখানে আসি ১৯৯০-তে। এরপর এই অঞ্চলের মানুষ, এখানকার জল-জঙ্গল, সব কিছুর সঙ্গেই কেমন একটা একাত্মতা অনুভব করতে থাকি। আর তখন থেকেই এখানে যাওয়া-আসা।
প্রশ্ন: ১৯৯০-এর বস্তার আর এখন এই ২০১৬-এ কি লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে? শিল্পের কারণে কিছুটা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন তো হয়েছেই। যেমন, সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এর ফলে আদিবাসী জনজীবনে উন্নয়নের কিছুটা প্রভাব কি পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর: আমার মনে হয়, বস্তার আরও পিছনের দিকে হেঁটে গিয়েছে। শুধু রাস্তা তৈরি হলেই তো আর জনজীবনের উন্নয়ন হয়েছে এমনটা বলা যায় না। আগে আদিবাসীদের হাট বসত। মানুষ মনের আনন্দে বেচাকেনা করত। এখন মানুষ সবসময়ে ভয়ে থাকে। তাদের তো দু’দিক থেকেই ভয়। যখন-তখন মাওবাদীরা পুলিশের চর সন্দেহে মেরে দিতে পারে। আর পুলিশি অত্যাচারের কাহিনি তো অবর্ণনীয়। আদিবাসী সুরক্ষার নামে বস্তারের প্রতি ২-৫ কিমির ভিতর বসেছে সিআরপিএফ-বিএসএফ-আইটিবিপি ক্যাম্প। এরা সারা ক্ষণ গ্রামবাসীদের উপর নজরদারি চালায়। মেয়েদের সুরক্ষা আরও অনিশ্চিত হয়েছে। যখন-তখন ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এদের অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। মেয়েদের স্কুলের কাছে ক্যাম্প বসলে ভয়ে মেয়েরা স্কুলে যেতে চাইছে না। স্কুল থেকে টেনে এনে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। এতে কি আপনার মনে হয় উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও বস্তারের প্রত্যন্ত গ্রামে, জঙ্গলে আদিবাসীদের কাছে পৌঁছেছে?
সূত্র: আনন্দবাজার