নির্বাসনের আবাসন
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০১৯, ২৩:৫০
এইমাত্র আমার সামনে একটা ৭ তলা বিল্ডিং ধসে পড়লো। মুহূর্তেই চারিদিকে ধুলা মানুষের চিৎকার কান্নাকাটির আওয়াজে পুরো জায়গাটা ভরে গেলো। দৌড়চ্ছে মানুষ বাঁচার জন্য, বাঁচানোর জন্য। আমি ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতে বাদামের ঠোঙা। বাদাম অধিকাংশই নষ্ট। ভেতরে কালো। ওই মানুষগুলোর মতো আমার দৌড়ানো উচিত মনে হয় বাঁচানোর জন্য। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। খারাপও লাগছে না , এতোগুলো মানুষ দুম করে মরে গেলো, মরার আগে জানতেই পারলো না যে মরে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য!
মরে গেছে, মরে যাবে। অহেতুক দৌড়ানোর মানে কি!
সেই ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে হেঁটে আমি সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছাই। বাড়িতে আলো নেই। কতদিন আলো নেই? শেষ কবে বিল দিয়েছিলাম? হবে হয়তো দুই তিন মাস আগে। একটা মোম জ্বালাই। তাতেই আমি সব দেখতে পাই। দেখতে পাই সোফাটা আগের জায়গায় আছে, তার একদম উপরে একটা ছবি ঝুলে আছে ধুলোমাখা। একটা সুখী পরিবারের হাসিখুশি ছবি। ছবিতে একটা নারী আছে, একটা পুরুষ আছে একটা শিশু আছে। এটা অতীত, বর্তমানে একজনই অবশিষ্ট আছে। বাকি দুইজন? নির্বাসন পেয়ে গেছে।
আমার শোবার ঘরে একটা আয়না আছে, সে আয়নায় আমি বহুকাল মুখ দেখি না। এক চেহারা দেখেছি অনেকবার। এখন আর দেখতে ইচ্ছে করে না। বাথরুমের আয়নাও ভাঙা। কেন জানি ভাঙা আয়নায় চেহারা দেখতে ইচ্ছে করে। প্রতিদিন দেখি। ওই ভাঙা ভাঙা আয়নায় দেখা যাওয়া আঁকাবাঁকা ক্ষতবিক্ষত চেহারাই যেন আসল চেহারা। মসৃণ চেহারা বড্ড বিশ্রী।
বারান্দায় আলোর কোন প্রয়োজন নেই। রাস্তার আলো আলোকিত করে তোলে চারিদিক। যদিও নিষ্প্রয়োজন এই আলো। অন্ধকারেই বসবাস যাদের তাদের কাছে আলো বাহুল্য। সামনে একটা এক তলা বিল্ডিংয়ে গত পরশু এক নবজাতক এসেছে। সারারাত কাঁদে। আমার বেশ লাগে শুনতে। সারারাত যেন কীর্তন বাজে কানে। মাদকে দোলে শরীর। মাঝে মাঝে কান্না থেমে যায়। তখন ইচ্ছে করে গিয়ে একটা চড় মেরে আসি। আবার কাঁদুক। আবার কীর্তন শুরু হোক। কিন্তু এই ইচ্ছে পূরণ করা যায় না। তখন বড় অস্থির লাগে। হাত পা চুলকায়। মাথার ভেতর কুটকুট করে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কাঁদে না কেন?
সকালে আমি বের হই কোথাও না যাওয়ার জন্য। গতদিনের ধ্বংসস্তূপের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বাহ! জায়গাটা তো আরও সুন্দর হয়ে গেছে। ইট সিমেন্টের ভাঙাভাঙা অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে আরও একটা ইমারত- ধ্বংসস্তূপের ইমারত। আশেপাশে রক্তও লেগে আছে মনে হয়। আমার ধরে দেখতে ইচ্ছে করে। ইটে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত দেখতে কেমন? একটা রক্তমাখা ইট হাতে তুলে নেই। কী সুন্দর! চকচকে রক্ত শুকিয়ে কালো কুচকুচে রক্ত গোলাপের মত ফুটে আছে। এর গন্ধও আছে বোধহয়। নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুঁকি একটা মরা মরা গন্ধ। আমি বিমর্ষ হয়ে যাই এই গন্ধে। মোহনীয়া মাতাল এক গন্ধে আমার ফুসফুস ভরে যায়। আমি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ি তখন আমাকে ডেকে তুলে এক বৃদ্ধ।
- এখানে কি করেন?
আমি তাকিয়ে থাকি।
- কেউ মরছে আপনার এখানে?
- না।
- তাইলে, এই পাথর লইয়া কি করেন?
লোকটার ঝুলে যাওয়া মুখের চামড়ার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। এই চামড়ার বয়স কত? এই চামড়া এতদিন টিকে আছে অথচ দেয়ালে ঝুলানো সেই ছবিটির শিশুটি নেই?
বৃদ্ধটি বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেলো।
আমি ইটটি পকেটে ঢুকিয়ে চলে গেলাম। তীব্র সৌন্দর্যের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তাকিয়ে থাকতে নেই।
হুট করে আকাশ কালো করে ঝড় আসে। বছরের প্রথম বৃষ্টি বোধহয়। কিছু পথশিশু নাচছে বৃষ্টি পেয়ে রোদের তাপের পরে। এদের হাসির ফোয়ারা বৃষ্টির গর্জন ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে। দৃশ্যটি চমৎকার হওয়ার কথা। কিন্তু আমার কোন সুন্দর লাগছে না। কুৎসিত লাগছে বরং। অন্যজনের হাসি দেখে নিজেরও হাসি পাওয়া ক্ষমতা লোপ পেয়েছে বহুদিন।
বৃষ্টিতে ভিজছি আজ অনেকদিন পর। এটাও আমাকে সুখ দিচ্ছে না। কতোগুলো পানি এসে গায়ে লাগছে তাতে সুখের অনুভূতি কেমন হতে পারে এই বোধ আমি ভুলে গেছি। আনন্দের অনুভূতি কেমন হতে পারে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
সামনে দিয়ে একটা রিকশা আসছে ঝড় উপেক্ষা করে। তাতে দুইজন নরনারী জড়াজড়ি করে বসে আছে। রিকশা কাছে আসতেই দেখি তারা একে অপরকে চুমু খাচ্ছে। তীব্র এবং গভীর চুমু। মেয়েটির নিশ্চয়ই সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছেলেটি নিশ্চয়ই শিহরিত হচ্ছে ভেতরে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি সেখানে। এই শিহরণ এই কম্পন আমার শরীরে জাগে না কত বছর? এই শিহরণের অনুভূতি কেমন? শরীরে কম্পন জাগলে কেমন লাগে? একসময় তো শিহরণ জাগতো। কেমন ছিল সেই অনুভূতি? আমি মনে করতে চাই। ভীষণভাবে মনে করতে চাই।
অন্ধকার আজ একটু কম। বিল দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের। ঘরে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে এক নারী বসে আছে। পথনারী বলে হয়তো তাকে, বা ঠিক পথ নারী না। এদের আলাদা নাম থাকে। কি নাম আমি জানি না। জানতে চাইও না। তাকে আমি এনেছি আমাকে কিছু অনুভূতি ফেরত দেওয়ার জন্য। কিছু অনুভূতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। যেগুলোর সাথে আমি বহুদিন পরিচিত ছিলাম এখন ভুলে গেছি। মেয়েটি লজ্জা পাচ্ছে না। অভ্যস্ত।
তাকে আমি কিছু খাবার দেই। পানীয়ও দেই। মেয়েটি পানীয়ও খেলো ইচ্ছেমত। তার বেশভূষা কিছুটা উগ্র। এই উগ্রতা দেখে কি আমার কাম জাগার কথা? কথাই তো। কিন্তু জাগছে না। এই না জাগার জন্য কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে। আমি মেয়েটিকে আমার ইচ্ছের কথা বলি। বলি সেই রিকশায় চুম্বনরত নরনারীর কথা। মেয়েটি হোহো করে হেসে উঠে। বলে সে নাকি দারুণ তৃপ্তি দিতে পারে। মেয়েটি আমাকে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরলো। আমি শরীরে একটা ভার ছাড়া আর কিছু অনুভব করলাম না।
মেয়েটির শরীর থেকে কর্কশ সুগন্ধি ভেসে আসল। এরপর সে আমার সারা শরীরে হাত বুলালো। আমি নিষ্কাম দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে সে আমার ঠোঁটের কাছে এসে চুম্বনের মত কিছু করলো। একে চুম্বন বলে কিনা জানি না তবে আমার কাছে চুম্বন মনে হল না।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে সে ঠোঁট লাগিয়ে লাগল। অনেক কসরত করছে মেয়েটি আমাকে আমার অনুভূতি ফেরত দেওয়ার জন্য। মেয়েটিকে এজন্য পুরষ্কার দেওয়া উচিত। কিন্তু যা আমাকে সে দিতে চাইছে বা আমি নিতে চাইছি তা হচ্ছে না। এক দলা থুথু গালে লাগা ছাড়া আমার কোনও অনুভূতি জাগল না। চুম্বনের অনুভূতি এমন বিস্বাদ হওয়ার কথা না। এমন নিরাবেগ হওয়ার কথা না। রক্তে আগুন ধরার কথা। লেগেছে কি? লাগে নি। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে মেয়েটির এমন ধস্তাধস্তি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই। তাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে সোজা দরজার বাইরে বের করে দিয়ে আসি।
মেয়েটি কিছু বলতে চেয়েছিল হয়তো। আমি শুনতে চাই নি।
সারা ঘর জুড়ে আলো কিলবিল করছে এদিক ওদিক। আলো নিভিয়ে দিয়ে আমার প্রিয় অন্ধকারকে আমন্ত্রণ জানাই।
তারা আসে। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। নিকষ আঁধারে আমি হাঁটুগেড়ে বসি। অনুভূতি ফেরত পাওয়ার ইচ্ছে আমার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। নিস্তব্ধ ঘর জুড়ে আমি কান পেতে কিছু শুনতে চাই। কিন্তু কি শুনতে চাই সেও জানি না। জানতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে।
আমি কিছুই শুনতে পাই না। নিস্তব্ধতা আমার ভেতরে শেকড় গাড়ছে।
সময় বয়ে যাচ্ছে, আমার শুনার ইচ্ছেও ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।