এসো পা বাড়াই (২৮ তম পর্ব)
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৭, ০০:৩৯
"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"
LEAN IN এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি
সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা
ঠিক আছে,তাহলে সব নারীদেরকে সমাজের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করতে হবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে, টেবিলে বসতে হবে, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং তখনই সারা পথ মসৃণভাবে পার হয়ে যাবে। এর মধ্যে সম্ভাব্য কি ভুল থাকতে পারে?
২০০৩ সালে কলম্বিয়া বিজনেস স্কুল (Columbia Business School) এর অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিন (Frank Flynn) এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় (New York University) এর অধ্যাপক ক্যামেরন অ্যান্ডারসন (Cameron Anderson) একটি নিরীক্ষা চালিয়েছিল, কর্মক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষদের উপলদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য। তারা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল (harvard business school) এর একটি কেস স্টাডি দিয়ে শুরু করেছিলেন, যা ছিল হাইডি রইজেন (Heidi Roizen) নামে বাস্তব জীবনে একজন উদ্যোক্তা এর উপর। কেসটিতে ব্যাখ্যা করা ছিল কিভাবে সে তার এই গুণাবলীগুলো ব্যবহার করে একজন সফল পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা হয়েছিলেন, “বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব- সুবিশাল ব্যক্তিগত এবং পেশাদারী নেটওয়ার্ক [যার] মধ্যে প্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী নেতারাও রয়েছেন। ফ্লিন এবং অ্যান্ডারসন অর্ধেক ছাত্রছাত্রীদেরকে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন হাইডি’র গল্পটি পড়ার জন্য এবং বাকী অর্ধেককে দিয়েছিলেন একই গল্প, শুধু একটি পার্থক্য করে- তারা 'হাইডি (Heidi)' নামটির বদলে 'হাওয়ার্ড (Howard)' করে দিয়েছিলেন।
তারপর হাইডি বা হাওয়ার্ড এর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মনোভাবের উপর অধ্যাপক ফ্লিন এবং অ্যান্ডারসন একটি জরিপ চালিয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা হাইডি এবং হাওয়ার্ডকে সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন, যা বোধগম্য কারণ 'তাদের' অর্জন ছিল পুরোপুরি অভিন্ন। এখনো যখন ছাত্রছাত্রীরা হাইডি এবং হাওয়ার্ড উভয়কেই সম্মান দেখাচ্ছে, তখনও হাওয়ার্ড সামনে চলে আসছে বেশী আকর্ষণীয় সহকর্মী হিসেবে। অন্যদিকে হাইডিকে দেখা হচ্ছে স্বার্থপর হিসেবে এবং সেরকম না “যেরকম ব্যক্তিত্বকে তুমি কাজে নিতে বা তার জন্য কাজ করতে চাও।” একই তথ্য-উপাত্ত, শুধুমাত্র একটি পার্থক্য - জেন্ডার/লিঙ্গ - অত্যন্ত ভিন্ন মনোভাব তৈরী করেছে।
এই নিরীক্ষাটি সমর্থন করে যা গবেষণায় ইতিমধ্যে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে: সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা পুরুষদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কযুক্ত এবং নারীদের সাথে নেতিবাচকভাবে সম্পর্কযুক্ত। যখন একজন পুরুষ সফলতা পায়, তাকে নারী পুরুষ উভয়ই পছন্দ করে। যখন একজন নারী সফলতা পায়, উভয় লিঙ্গের মানুষই তাকে কম পছন্দ করে। এই সত্যটা একইসাথে অত্যন্ত বেদনাদায়ক আবার বিস্ময়কর নয়: অত্যন্ত বেদনাদায়ক কারণ কেউই কখনো স্বীকার করে না লিঙ্গ বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে বাঁধাধরা নিয়ম চালু রাখাটিকে এবং বিস্ময়কর নয় কারণ পরিষ্কারভাবেই আমরা তা করি।
দশকের পর দশক ধরে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা নিশ্চিত করেছে যা হাইডি/হাওয়ার্ড এর কেস স্টাডি এরকম নির্লজ্জভাবে দেখিয়েছে: আমরা মানুষকে মূল্যায়ন করি বাঁধাধরা নিয়মের উপর (লিঙ্গ, বর্ণ, জাতীয়তা এবং বয়স, অন্যান্যের মধ্যে)। আমাদের বাঁধাধরা নিয়মে পুরুষদের ছকের ঝুলিতে আছে যে তারা প্রদানকারী, বিচার ক্ষমতাসম্পন্ন, এবং পরিচালক। আমাদের বাঁধাধরা নিয়মে নারীদের ছকের ঝুলিতে আছে যে তারা সেবাদানকারী, সংবেদনশীল এবং সামাজিক। আমরা পুরুষ এবং নারীকে একে অপরের বিপরীত বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করার কারণে, পেশাগত অর্জন এবং এর সাথে জড়িত অন্য সব বৈশিষ্ট্যগুলো জায়গা করে নিয়েছে পুরুষের কলামে। কর্মজীবনের উপর তার মনোযোগ নিবদ্ধ করে, আশ্চর্যজনক ক্ষমতার প্রতি হিসাব নিকাশ করে অগ্রসর হয়ে হাইডি, নারীদের প্রতি আমাদের বাঁধাধরা নিয়মের প্রত্যাশাকে লঙ্ঘন করেছেন। এখনও একই রকম আচরণ করেও হাওয়ার্ড, পুরুষদের প্রতি আমাদের বাঁধাধরা নিয়মের প্রত্যাশার ছকের মধ্যেই বসবাস করছেন। সবশেষে ফলাফল কি? পুরুষটিকে পছন্দ করছি, আর নারীটিকে অপছন্দ করছি।
(চলবে...)