আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০১৬, ০৪:১০
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার রিকশাচালক মৃত এমাজ উদ্দিন ও শরিফা বেগমের একমাত্র কন্যা ছিল ইয়াসমিন বেগম। শহরের লালবাগ কোহিনূর স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কিশোরী ইয়াসমিনের। সংসারে অভাবের তাড়নায় মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে ঢাকায় যায়। সে আবুল আহসান আহমদ আলী নামের এক ব্যক্তির ঢাকার ধানমন্ডি ১নং সড়কের ১৩নং বাসার এক পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজ করত। আবুল আহসান আহমদ আলীর গ্রামের বাড়িও দিনাজপুর জেলায়।
টানা তিন বছরে একবারও দিনাজপুরে মায়ের কাছে আসা হয়নি ইয়াসমিনের। তাই বাড়িতে আসার জন্য বিশেষ করে মাকে দেখার জন্য ভীষণ উতলা ছিল সে। গৃহস্বামী তাকে দুর্গাপূজার ছুটিতে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা ইয়াসমিন সে বাক্যে সান্ত্বনা পায়নি। সম্ভবত তাই ওই বছরের ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় সে।
১৯৯৫ সাল। ২৪ আগস্ট। স্থান দশ মাইল মোড়। সময় তখন ভোর ৪টা। দিনাজপুর শহর অভিমুখে ফিরতে অপেক্ষমাণ কিশোরী ইয়াসমিন। মাকে দেখতে ইয়াসমিন ঢাকা থেকে রওনা দেন গাইবান্ধাগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশকোচে। রাতে দিনাজপুরে নেমে যায় সে। ফজরের নামাজ পড়তে বের হওয়া স্থানীয় মুসল্লিরা নিরাপদে যেতে তাকে তুলে দিলেন একটি পুলিশ ভ্যানে। তারা কোতোয়ালি পুলিশকে অনুরোধ করলেন দিনাজপুরে পৌঁছে দিতে। তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার নাম করে পিকআপে তুলে নেয় পুলিশ। কিন্তু পুলিশী হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় কিশোরী ইয়াসমিন। রাতভর পুলিশের ধর্ষণের শিকার হয়ে ইয়াসমিন বাড়ি ফেরে ধর্ষিত লাশ হয়ে।
পরের দিন সকালে ইয়াসমিনের লাশ পাওয়া যায় দিনাজপুর দশমাইল মহাসড়কে রানীগঞ্জ ব্র্যাক অফিসের সামনে। পরবর্তী সময় ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ শেষে খুন হয়েছিল দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন।
এই ঘটনায় প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে দিনাজপুর। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। দিনাজপুর কোতোয়ালী পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা ফাইল করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে বালু বাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়।
২৫ আগস্ট ’৯৫ আগের দিন ঘটনার পরে পুলিশ প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া ও অন্যখাতে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে রহস্যময় আচরণ করে আসছিল তার অংশ হিসেবে নিহত ইয়াসমিনকে ‘পতিতা বানু’ বানাবার চক্রান্ত চালায়। ২৬ আগস্ট স্থানীয় জনতা রামনগর মোড়ে মিটিং আহ্বান করে প্রচারণা চালানোর সময় কোতোয়ালী থানা এলাকায় পুলিশ মাইক ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনায় আশেপাশের এলাকার লোকজন সংগঠিত হয়। সন্ধ্যার পরে রামনগর মোড়ে ইয়াসমিনের গায়েবি জানাজা শেষে রাত দশটার দিকে প্রতিবাদী জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে কোতোয়ালী থানা ঘেরাও করে অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ, ন্যায্য বিচার ও শাস্তি দাবি করে। হাজার হাজার জনতা কোতোয়ালি থানার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং সারারাত থানা অবরোধ করে রাখে। এসময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এতে আট-দশজন ব্যক্তি আহত হয়।
২৭ আগস্ট শহরে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই সকাল এগারোটার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবীতে বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে একটি বিশাল মিছিল বের করলে মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালালে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ।
পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ জনতা দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা, ৩টি পুলিশ ফাঁড়ি, কাস্টমস গোডাউন, প্রেসক্লাব, ৪টি পত্রিকা অফিসসহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। শহরের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা (কার্ফু) জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
অবশেষে এ ঘটনায় ক্ষমা চায় প্রশাসন।
এসব ঘটনায় দিনাজপুরবাসীর পক্ষে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে নিরাপত্তা জনিত কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় রংপুরে। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামী পুলিশের এ,এস,আই মইনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিক আপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ,এম,আই মইনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অপর দিকে দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডাঃ মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এ,এস আই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীর-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মামলার অন্যতম আসামী এ.এস.আই মইনুল হক (পিতা-জসিমউদ্দীন, গ্রাম-বিশ্রাম পাড়া, উপজেলা-পলাশবাড়ী, জেলা-গাইবান্ধা) ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার (পিতা-এস.এম খতিবুর রহমান, গ্রাম-চন্দনখানা, উপজেলা-ডোমার, জেলা-নীলফামারী) কে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১ সেপ্টেম্বর ’০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে। অপর আসামী পিক আপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণ ( পিতা-লক্ষ্মীকান্ত বর্মণ, গ্রাম-রাজপুর, উপজেলা-সদর, জেলা-নীলফামারী) কে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর ’০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে।
উপমহাদেশের ইতিহাসে দোষী পুলিশদের ফাঁসিতে মৃত্যু কার্যকরের ঘটনা এটাই প্রথম।
প্রতি বছর ২৪ আগস্ট এই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু নিহত ইয়াসমিনের মা ও নারী সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, নারী নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি।
ইয়াসমিনের স্মরণে দিনাজপুরের দশ মাইল এলাকায় তৈরি করা হয়েছে ইয়াসমিন সরণি। এদিকে দিবসটি এলেই দিনাজপুর শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্তানে ইয়াসমিনের কবরটি চুনকাম করা হলেও ইয়াসমিন ঘটনায় নিহত সামু, কাদের ও সিরাজের স্মৃতিফলকগুলো অবহেলায় শহর থেকে হারিয়ে গেছে। তাছাড়া ইয়াসমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা ও বাস্তবায়িত হলেও আজ পর্যন্ত ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে যারা মারা গেছেন, তাদের হত্যাকারীদের বিচার হয়নি।