উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক (প্রথম অধ্যায়: সনাতন মূল্যবোধ-৩)
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০১৭, ০২:৩২
উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক, বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তার গবেষণার আলোকে লেখা।
পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেঁছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো!!!
এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
৬.
লেখক অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত নিয়ে এসেছেন বহুবিবাহ বিষয়ে, এনেছেন গবেষণা তথ্য।
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থই বহুবিবাহ অনুমোদন করে, যদিও চারজন স্ত্রীর বেশি স্ত্রী রাখা শরিয়তবিরুদ্ধ।
বহুবিবাহ অনেক নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করেছে, অনেক স্ত্রী দুঃসহ কষ্ট ভোগ করে মারা যায়। অনেকে একাধিক পত্নী থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য বাইজীদের নিয়ে আমোদ ফূর্তি করতেন।
৭.
এরপর এসেছে যৌতুক প্রথা নিয়ে গবেষণা বিশ্লেষণ। যৌতুকপ্রথা বিয়ে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।
বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা ভিন্নতর স্থানে ও আঙ্গিকে ক্রমবিবর্তিত হয়ে একই রূপ ধারণ করেছে।
উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে যৌতুকপ্রথার প্রচলন ছিল। মুসলমানদের দেনমোহর সেই সময় সামাজিক বিত্তের একটি নিদর্শনে পরিগণিত হয়।
৮.
এসেছে সেই সময়ের হিন্দু ও মুসলিম বিয়ের নানান আচারিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের চমকপ্রদ সব তথ্য ও উদাহরণ। লেখক বিশেষ করে উনিশ শতকের পুরনো ঢাকার বিয়ের রীতির অনেক কিছু খুব সুন্দর করে উল্লেখ করেছেন, পড়তে যেয়ে যে কারো ভালো লাগবে।
ছোট একটা অংশ উল্লেখ করি, বিয়ের পরদিন বরের বাড়িতে নতুন বৌকে ডাক শেখানো হতো। স্বামীর আত্মীয়রা একসঙ্গে ঘরে বসে থাকতো। তখন নূতন বৌ হাতে পান ও মিষ্টি নিয়ে একজন একজন করে সবার সামনে যেতো। সঙ্গে থাকতো ননদ বা ননাস। সে একেকজনকে পরিচয় করিয়ে দিতো ‘ইনি আপনার খালাশাশুড়ি, উনাকে আমরা খালাম্মা ডাকি’। নূতন বৌ তখন হাতের পান ও মিষ্টি খালাশাশুড়ির হাতে দিয়ে বলতো, ‘খালাম্মা নিন’।
৯.
অষ্টাদশ শতাব্দীতে হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। উনিশ শতকের আলোচনার এই কেন্দ্রবিন্দুতে তা চলে আসে। তাই লেখক তুলে এনেছেন ‘সতীদাহ বা মৃত স্বামীর চিতায় বিধবা স্ত্রীর সহমরণের প্রথার মতন বর্বরতম প্রথা নিয়ে বিস্তারিত একটি অধ্যায়।
১৮২২ সালে ফ্যানি পার্কস একটি সহমরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তিনি দেখেছিলেন যে প্রজ্জ্বলিত চিতা থেকে যখন বিধবাটি প্রাণের ভয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলো তখন তার আত্নীয়-স্বজন এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা ‘কেটে ফেলো’, ‘মাথায় বাঁশ মারো’, ‘হাত-পা বাঁধো’, বলে চিৎকার করে করে বিধবার পিছনে ছুটছিলো।
১০.
তুলে এনেছেন, পর্দার নামে নারীকে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ করে রাখার কথা। নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করার শালীনতা নিয়ন্ত্রণ করার একটু পীড়নমূলক পদ্ধতি হিসেবে সমাজে পর্দা চালু করা হয়েছে।
তবে জানা যায়, প্রাচীন বাংলায় পর্দাপ্রথা তেমন একটা প্রচলন ছিল না। অভিজাত ও বিত্তবান পরিবারের মহিলারা পর্দা মেনে চলতেন।
‘অবরোধ প্রথা’ নিয়ে লেখক প্রাসঙ্গিক অনেক মতবাদ এবং তথ্য তুলে এনেছেন।
উনিশ শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বিশেষ করে মুসলিম নারীদের কি কঠোর পর্দা মেনে চলতে হতো তার বেশ কিছু চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন এই অধ্যায়ে।
উনিশ শতকের শেষে হান্টার ঢাকার পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, নারীরা সাধারণত শাড়ি, ছেলেরা সাধারণত ধুতি, চাদর, গামছা, খড়ম প্রভৃতি ব্যবহার করতো।
১১.
ধর্মীয় আধিপত্য যেভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্কে প্রভাব রেখেছে তার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। নানান ভাবেই উঠে এসেছে সাধ্বী স্ত্রীলোকের পরমধর্ম পতিপরায়ণতা। কিন্তু ধর্মানুসারে স্বামীর পক্ষে পত্নীব্রত হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না কোনোদিন।
ধর্ম একদিকে বিবাহিতা স্ত্রীকে গৃহের মধ্যে কঠোরভাবে আবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে, আবার অপরদিকে পুরুষের যত্রতত্র নারী সম্ভোগের দ্বারটি খোলা রেখেছে।
শ্রীপান্থের ‘হারেম’ গ্রন্থ থেকে লেখক উল্লেখ করছেন, 'নবাবদের হারেমে থাকতো অগণিত দাসী। হারেমে মেয়েরা বিভিন্ন শিক্ষাগ্রহণ করতো নবাবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে, বাঁদিরাও কেউ কেউ পুরোপুরি অশিক্ষিত ছিল না'।
১২.
এসেছে বিবাহ বিচ্ছেদ বিষয়ক আলোচনা।
তত্ত্বগতভাবে ইসলামি শরিয়ত আইনে নারীপুরুষের যে কেউই দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। কোরআনে বিবাহবিচ্ছেদের কথা বহু জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোরআনের অপব্যাখ্যা করে অনেক পুরুষ যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত নিতে নারীকে প্ররোচিত করে।
উনিশ শতকে হান্টার নোয়াখালি জেলা সম্পর্কে লিখেছেন যে, সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বিরল, বিশেষ করে যেখানে সন্তান আছে. হয়ত বিবাহবিচ্ছেদে বা তালাক মুসলিম নারীর জন্য অসম্মানের ছিল।
১৩.
পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে সম্পত্তির অধিকার পিতার। জ্যেষ্ঠপুত্রই সকল সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্য। তাই সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারের জন্য পুত্র থাকা অনিবার্য।
পারিবারিক ধনসম্পত্তিতে নারীর কোনো বিধি-বিধানগত ব্যক্তিগত অধিকার বা সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না।
সম্পত্তিতে নারীর অধিকার বিষয়ে নানান মতামত এখানে তুলে ধরেছেন লেখক।
(চলবে...)