মিতুর খুনীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০১৬, ১৮:২২
চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের পলাতক খুনিদের গ্রেপ্তার করতে জোরদার অভিযান চালানোর পাশাপাশি তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেজন্য মূলহোতা কামরুল সিকদার ওরফে আবু মুছাসহ অন্যদের ছবিসহ সকল তথ্য দেশের সকল বিমান, নৌ ও স্থল বন্দরে পাঠিয়েছে সিএমপি।
তাদের নাম-ঠিকানা এবং ছবি দিয়ে দেশের সব বিমান ও স্থল বন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়। আসামিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মিতু হত্যার পুরো চিত্র এখন তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। ভিডিও ফুটেজের পাশাপাশি গ্রেপ্তারকৃত দু’ আসামী ওয়াসিম এবং আনোয়ারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়ায় বাকি আসামীদের শনাক্তে সুবিধা হয়েছে।
এর মধ্যে কিলিং মিশনের অন্যতম দু’ আসামী মুসা এবং নবী’র ছবিসহ যাবতীয় তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তার সাথে রেকিতে থাকা রাশেদ, শাহাজাহান এবং কালু’র তথ্যও বাদ যায়নি। এ অবস্থায় পুলিশের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে তাদের বিদেশ পালানো ঠেকানোর প্রক্রিয়া।
এরা হলেন, ঘটনার মূল হোতা কামরুল সিকদার ওরফে আবু মুছা, কিলিং মিশনে থাকা ওয়াসিম ও নবী। এছাড়া অস্ত্র সরবরাহকারী এহতেশামুল হক ভোলা, ঘটনাস্থলে হত্যাকারীদের সহযোগি হিসাবে থাকা রাশেদ, কালু, শাহজাহান ও আনোয়ার।
এদের মধ্যে ভোলা, ওয়াসিম, আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভোলার সহযোগি মনির হোসেনকেও অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তারেরর জন্য দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ঘটনার মূল হোতা কামরুল সিকদার ওরফে আবু মুছা এবং সহযোগি রাশেদ, কালু, শাহজাহানের।
সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘আনোয়ারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে যাদের নাম এসেছে তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে আমাদের বিভিন্ন টিম বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখান থেকেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এবং যাতে তারা দেশ ছেড়ে না যেতে পারে সেজন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা খুনিদের ব্যাপারে যতটুকু তথ্য পেয়েছি ততটুকু দেশের সবগুলো সীমান্তের চেকপোস্টে দিয়েছি। সেই সাথে তাদের আমরা ছবিও পাঠিয়েছে, যাতে কোনো আসামি দেশ ত্যাগ না করতে পারে।’
রবিবার (২৬ জুন) আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানিয়েছেন, আবু মুছার নির্দেশে জিইসি মোড় এলাকার বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে খুনের জন্য তারা গত ৫ জুন ভোরে জড়ো হয়। এই হত্যা মিশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল মুছার ওপরই। তার নির্দেশনা মতে টাকার বিনিময়ে মোট সাতজন এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে ১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানান, গত ৫ জুন ভোরে জিইসি মোড়ের অদূরে ও আর নিজাম রোডে ৭ জনের একটি দল মিতু হত্যার মিশনে অবস্থান নেয়। মূল হত্যা মিশনে অংশ নেন ওয়াসিম ছাড়াও মুছা ও নবী। এর মধ্যে মিতুকে অনুসরণ করেন ওয়াসিম। পুলিশের উদ্ধার করা ভিডিও ফুটেজে যাকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে সে হচ্ছে ওয়াসিম। ওইদিন ভোর রাতে মুসা ও অন্য একজন মোটরসাইকেলে প্রবর্তক আসে। বাকিরা একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে প্রবর্তক মোড় আসে।
এর আগে কালামিয়া বাজারে মুসা সিএনজি ভাড়া বাবদ ৫০০ টাকা দেয় ওয়াসিম ও অন্যদের। এভাবে ভোরে ৭ জন প্রবর্তক মোড়ে এসে জড়ো হয়। এরপর তারা হেঁটে গোলপাহাড় এলাকায় পৌঁছে। ওয়াসিম গোলপাহাড় মন্দিরের বিপরীতে রয়েল হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে মিতু বের হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে। আর মুছা ও নবী মোটরসাইকেল নিয়ে নিরিবিলি হোটেলের সামনে অবস্থান নেয়। আনোয়ার মিতুদের বাসার রাস্তার পাশে টিঅ্যান্ডটি বাক্সের পাশে অবস্থান নেয়। অন্যরাও গোলপাহাড় থেকে জিইসি মোড়ের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। হামলাকারীরা আক্রান্ত হলে অন্যরা ছুটে আসার পরিকল্পনা ছিল।
মিতু ছেলে মাহিরের হাত ধরে মূল রাস্তায় বের হলে নিরিবিলি হোটেলের সামনে থাকা মুছা বিপরীত দিক থেকে মোটরসাইকেলে মিতুকে ধাক্কা দেয়। আর মোটরসাইকেল থেকে নেমে সামনে পেছনে ছুরিকাঘাত করেন নবী। এরপর মিতুর পিছনে যাওয়া ওয়াসিম একটি মিস ফায়ার করেন। সেটি মিস ফায়ার হওয়ায় তার কাছ থেকে পিস্তল নিজ হাতে নিয়ে মিতুর মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করেন মোটরসাইকেলের চালকের আসনে থাকা আবু মুছা নিজেই। ঘটনাস্থলেই মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মুছার মোটরসাইকেলে করে নবী ও ওয়াসিম নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে প্রথমে ষোলকবহর যায়।
সেখান থেকে মুছার কালামিয়া বাজারের বাসায় চলে যায় তারা। সেখানে হত্যাকাণ্ডে ব্যাকআপ টিমের আনোয়ারসহ অন্য তিন সদস্য জিইসি মোড় থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে।
বহদ্দারহাট হয়ে কালামিয়া বাজারের বাসায় যোগ দেয়। এদের কয়েকজনকে তাৎক্ষণিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে দেয় মুছা। এরপর সবাই নিজ নিজ বাসায় চলে যায়।
এদিকে, মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে মামলার বাদী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। মুসাসহ কয়েকজন আটক বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তবে পুলিশ তা নাকচ করে আসছে।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শুরুতে জঙ্গিদের দায়ী মনে করলেও তদন্তকারীরা এখন বলছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা পেশাদার অপরাধী।
এছাড়া হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা বড়ভাইয়ের নাম এখনো প্রকাশ করেনি পুলিশ। এছাড়া এসপি বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি এখন পর্যন্ত। বিষয়টিকে আরও ঘনীভূত করেছে বাবুল আক্তারের স্বেচ্ছায় গৃহবন্দিত্ব। জানা গেছে, তিনি অফিস করছেন না, আবার শ্বশুরবাড়ি থেকেও বেরুচ্ছেন না।