নীলনয়না মডেল রাওদার লাশ নিতে বাংলাদেশে পরিবার

প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০১৭, ০১:৩৩

জাগরণীয়া ডেস্ক

রাজশাহীতে আত্মহত্যা করা নীলনয়না মডেলকন্যা রাওদা আতিফের লাশ নিতে মালদ্বীপ থেকে তার পরিবার বাংলাদেশে এসেছে। রাওদার বাবা ও মাসহ পরিবারের তিন সদস্য বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় পৌঁছেন। এরপর বিকেলে সড়কপথে তারা রাজশাহী রওনা হন। তবে সন্ধ্যা নাগাদ এই প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত তারা রাজশাহীতে পৌঁছাননি। তারা রাজশাহী পৌছে সিদ্ধান্ত দেবেন, রাওদার লাশের ময়নাতদন্ত হবে কী না।

এদিকে রাওদার আত্মহত্যার কোনো কারণ এখনো খুঁজে পায়নি পুলিশ। রাওদা আতিফ যে আন্তর্জাতিক মডেল ছিলেন তা তার মৃত্যুর আগে জানতেন না সহপাঠিরা। এমনকি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছেও রাওদা বিষয়টি কখনো জানাননি। চলাফেরায় ছিলেন একেবারেই অন্তর্মুখী। জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে ঘোরাঘুরি করতেন না। বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা বা হৈচৈয়েও তেমন থাকতেন না মালদ্বীপের এই শিক্ষার্থী। লেখাপড়া আর নিজের কক্ষটিই ছিল তার জগত।

সহপাঠিরা জানান, মেডিকেল কলেজের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অন্য বিদেশী শিক্ষার্থীরা খুব একটা হাজির থাকতেন না। কিন্তু রাওদা ঠিকই অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। ঘুরে ঘুরে ছবি উঠাতেন। কোনো ধরনের অহমিকাও ছিল না। সবার সাথেই কথা বলতেন ভাঙা ভাঙা বাংলায়। কিন্তু হুট করেই যে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেবেন তা কেউই ভাবতেই পারছেন না। সদ্য টিন অতিক্রান্ত রাওদা আতিফের (২০) মরদেহ এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের হিমঘরে।

রাওদার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বৃহস্পতিবার বন্ধ রাখা হয় ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের সকল ক্লাস ও পরীক্ষা। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটিও করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. আব্দুল মুকিত সরকারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে বুধবারই রাওদার মৃত্যুর খবর পান তার পরিবার। বৃহস্পতিবার বিকেলে বিমানে করে রাজশাহীতে আসেন বাংলাদেশে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত আয়েশাথ শান সাকির এবং কমনওয়েলথের সেকেন্ড সেক্রেটারি ইসমাইল মুফিদ। তারা প্রথমে ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। এ সময় তারা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।

পরে সেখান থেকে তারা রাজশাহী সার্কিট হাউজে গিয়ে ওঠেন। তবে রাওদার বাবা মোহাম্মদ আতিফ, মা আমিনাথ মুহারমিমাথসহ পরিবারের তিন সদস্য বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় পৌছেন। এরপর বিকেলে সড়কপথে তারা রাজশাহী রওনা হন। তবে সন্ধ্যা নাগাদ তারা রাজশাহীতে পৌছাননি। রাওদার মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে কি না সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি তার পরিবার।

পুলিশ জানিয়েছে, মডেল রাওদার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে কাজ শুরু হয়েছে। প্রেম বা ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছিল কি না তাও জানতে পারছে না পুলিশ। 

নগরীর শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেন, "রাওদার সহপাঠিদের সঙ্গে  কথা বলে জানা গেছে, একদিন পরই তার টিউটেরিয়াল পরীক্ষা ছিল। তাই পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন রাওদা। তবে কেবল পড়াশোনার চিন্তার কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া প্রেম বা পারিবারিক কোনো বিষয় আছে কি না তাও জানার চেষ্টা চলছে। তার পরিবারের সঙ্গে কথা হলেও হয়তো কিছু জানা যাবে"।

জানা গেছে, রাওদা এক সময় প্রখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের মডেল হয়েছিলেন শখের বসে। শিক্ষার টানে মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ এসে ভর্তি হন। তিনি রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ এমবিবিএস ১৩তম ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। বিদেশি কোটায় ভর্তির পর গত বছরের ১৪ জানুয়ারি কলেজের মহিলা হোস্টেলের দ্বিতীয় তলার ২০৯ নম্বর ওই কক্ষে ওঠেন রাওদা। এরপর থেকে সেখানেই থাকতেন। হোস্টেলের ওই ব্লকে আরও ছয়জন বিদেশি ছাত্রী থাকেন। রাওদা আতিফের মডেলিংয়ের কিছু ছবি ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়। তবে বৃহস্পতিবার ব্রাউজ করে দেখা যায় ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সহপাঠিরা জানিয়েছেন, পশ্চিমা পোশাক ছাড়ার চাপে ছিলেন ‘নীল নয়না’ মডেল কন্যা রাওদা। গত বছরের ২২ অক্টোবর প্রকাশিত খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক ফ্যাশন পত্রিকা ভোগ ইন্ডিয়ার নবম বর্ষপূর্তি সংখ্যার প্রচ্ছদে মডেল হিসেবে তার ছবি ছাপা হয়। ‘নীল নয়না’ হওয়ায় মডেল তারকা হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান তিনি। লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘ভোগ’-এর কাভারগার্ল হওয়ার সুযোগ পাওয়া নিহত রাওদা আতিফ ছিলেন মালদ্বীপের সেলিব্রিটি মডেল।

নিজ দেশের বাইরে ভারতেও তিনি মডেলিং করেছেন। তবে সহপাঠিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব একটা সাবলীল ছিল না। র‌্যাম্পে ঝড় তোলা এই মডেল নিজের মতোই থাকতেন। পশ্চিমা পোশাকেই তিনি অভ্যস্ত হলেও কলেজের ক্লাসে নিয়ম অনুযায়ী ওড়না মাথায় দিতেন। তবে ব্যবহারিক ক্লাসে খোলামেলা পোশাকেই যেতেন। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে কানাঘুঁষাও ছিল।
 
ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ও মালদ্বীপের নাগরিক আইশাত নাজা ফাইজ ছাত্রী হোস্টেলে রাওদার পাশের কক্ষেই থাকেন। 

তিনি বলেন, ঘটনার আগে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত তাদের নানা বিষয়ে কথা হয়েছিল। রাওদা স্বল্পভাষী হলেও খুবই উদার ও মিষ্টি মনের ছিল। তারা দুজন মিলে হোস্টেলের সামনে আমগাছে দোলনা তৈরি করে বিকেলে তাতে দোল খেতেন। কিন্তু এভাবে আত্মহত্যা করবে তা ভাবতে পারছেন না তিনি। 

তবে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের সেক্রেটারি আব্দুল আজিজ রিয়াদ বলেন, মেডিকেল কলেজের ড্রেসকোড মেনে চলতেন রাওদা। এ নিয়ে কখনো কোনো চাপাচাপি ছিল না। ক্লাসের বাইরে যে যার মতো পোশাক পরে। এখানে কলেজে কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।

তিনি জানান, রাওদার আত্মহত্যার বিষয়টি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন সে বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারছেন না। তবে কলেজের পক্ষে তিনি বাদী হয়ে থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেছেন।

উল্লেখ্য, ২৯ মার্চ, বুধবার বেলা ১১টার দিকে হোস্টেলের ২০৯ নম্বর কক্ষে রাওদার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে অন্য ছাত্রীরা দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন। এক পর্যায়ে দরজার ছিটকানি খুলে যায়। এ সময় তারা সিলিং ফ্যানে ওড়নার সঙ্গে রাওদাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে পাঠায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত