কাপড়ে রঙ লাগায় গৃহকর্মীর গায়ে আগুন!

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০১৭, ১৩:০৮

জাগরণীয়া ডেস্ক

তার অপরাধ ছিল কাপড় ধোয়ার সময় এক কাপড়ের রঙ অন্যটিতে লেগে যায়। তাই এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে প্রথমে গৃহকর্তা ও তার ছেলের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন চলে। কিন্তু তাতেও আদের সাধ না মেটায় গৃহকর্ত্রী তার গায়ে ঢেলে দেন ফুটন্ত গরম পানি। এরপরেও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে উল্টো ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে ওই গৃহকর্মীকে আটকে রাখা হয় বাথরুমে। নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর প্রচার করা হয়, নিজেই গায়ে আগুন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ওই গৃহকর্মী। 

সামান্য এক ভুলের জন্য এমন মর্মান্তিক নির্যাতনের কথা কোন সিনেমা বা কল্পকাহিনী নয়, বরং বাস্তব। নির্যাতিত সেই গৃহকর্মী ফাতেমাকে ঢাকা থেকে খুলনায় নিয়ে সেখানকার খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফেলে যেন নিজের অপরাধের দায় মেটান ওই গৃহকর্তা।

প্রায় নয় মাস আগে অভাবের তাড়নায় রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার জনৈক দেলোয়ার হোসেনের বাসায় কাজ নিয়েছিলেন স্বামীছাড়া তরুণী ফাতেমা। তিনি বাগেরহাটের মংলার সিগনাল টাওয়ার এলাকার মোজাম সরদারের মেয়ে। গত ১৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার) সকালে তিনি ওই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই হাসপাতালে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হার মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি।

কিন্তু বেঁচে থাকতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরিবারের সদস্যের কাছে তার ওপর চলা লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন ফাতেমা। ফাতেমা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই  তার সেই বক্তব্য রেকর্ড করে রাখেন তার পরিবারের সদস্যরা।

ওই বক্তব্যে ফাতেমা জানান, গত বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সকালে তিনি কাপড় ধুতে গেলে দুটি কাপড়ে রঙ লেগে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহকর্তা দেলোয়ার ও তার ছেলে আশিক তাকে (ফাতেমা) মারধর করে। পরে গৃহকর্ত্রী সালমা তার শরীরে ফুটন্ত গরম পানি ছুড়ে দেয়। এতে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়। দগ্ধ অবস্থায় আর্ত চিৎকার করতে থাকেন তিনি। কিন্তু, তাকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ঘটনাটি আড়াল করার জন্য গৃহকর্ত্রী ও অন্যরা তাকে জোর করে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর কেরোসিন এনে তার গায়ে ঢেলে দিয়ে দিয়াশলাই ঠুকে দেয়। ফুটন্ত পানিতে দগ্ধ হওয়ার পর কেরোসিনের আগুনে আরও মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন তিনি। 

ফাতেমা বলেন, "এরপর বাড়ির লোকজন বলতে শুরু করে, বাথরুমে ঢুকে আমি (ফাতেমা) নাকি নিজেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়েছি"।

ফাতেমা বলেন, "এমন অবস্থাতেও তারা ঢাকায় আমার কোনও চিকিৎসা করায়নি। ওই দিন সন্ধ্যায় তারা প্রাইভেট কারে আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করে"।

ফাতেমার ছোট ভাই ইউনুছ সরদার বলেন, "গৃহকর্ত্রী সালমা আমাকে ফোন করে জানান যে ফাতেমার গায়ে আগুন লেগেছে। তাকে নিতে যাওয়ার কথা বলেন সালমা। কিন্তু আমাদের কোনও খোঁজ দেননি তারা। পরের দিন সালমা জানান, ফাতেমাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে আমার দগ্ধ বোনকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি"।

এরও দু’দিন পর মঙ্গলবার সকালে ফাতেমা হাসপাতালে মারা যান। সেখান থেকে তার মরদেহ মংলায় আনার পর পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য বাগেরহাট মর্গে পাঠিয়েছে।

নিহত ফাতেমার বড় বোন অরুনা বেগম বলেন, "যে বাড়িতে ফাতেমা কাজ করছিল, ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ভালো কাজ ও বেতনের লোভ দেখিয়ে ফাতেমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু কাজ করিয়ে নিত পেটে-ভাতে। এই নির্মম নির্যাতনের বিচার চাই আমরা"।

এ বিষয়ে মংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লুৎফুর রহমান বলেন, "পুলিশ খবর পেয়ে নিহত ফাতেমার বাড়িতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে ঘটনার অনুসন্ধান করেছে। পরে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে জন্য বাগেরহাট মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ফাতেমাকে নির্যাতন করে আগুনে পুড়িয়ে দগ্ধ করার প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে অবহিত করা সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে"।

বিষয়টি সম্পর্কে এখনও জানতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) আবু সাঈদ আল মামুন জানান, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে এখনও কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত