৪৬ বছরেও অরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ-ট্রানজিট
‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি মেলেনি মাস্টার দম্পতির
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪৬
৭১’র মুক্তিযুদ্ধে নিজ বাড়িতে প্রশিক্ষণ ও ট্রানজিট ক্যাম্প গড়ে তুলেছিলেন স্কুলশিক্ষক ইজ্জত আলী মাস্টার ও তার স্ত্রী গৃহিনী রেজিয়া খাতুন। লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের চন্দ্রপুরের বাগানবাড়ি নামে খ্যাত তার বাড়ির সামনের আমের বাগানটি ছিল যুদ্ধকালীন মুক্তাঞ্চল কালিগঞ্জ থানা। ওই ক্যাম্পেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বীরপ্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত হারেছ উদ্দিন সরকার, মাহাতাব উদ্দিন সরকার ও সামসুল হক।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই প্রশিক্ষণ ও ট্রানজিট ক্যাম্প বাড়িটি ৪৬ বছর ধরেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এবং থানা ক্যাম্পাস সংরক্ষণের কোন চেষ্টাই করা হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও সুরাহা মেলেনি। শুধু তাই নয়, ওই দম্পতির মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও মেলেনি। তার আগেই মারা গেছেন সংগঠক ইজ্জত আলী মাস্টার। আর বেঁচে থাকা রাজিয়া খাতুন স্বীকৃতি না পেয়ে কষ্টে দিন পার করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঐতিহাসিক ইজ্জত আলী মাস্টারের ওই বাড়িতে সব ধরনের গাছ গাছালি থাকায় বাড়িটি বাগানবাড়ি নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। দেশ তখন রণক্ষেত্র। বাগানবাড়ির মালিক ইজ্জত আলী মাস্টার তখন চন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্ত্রী রেজিয়া খাতুনের কোলে তখন ৪ বছর, ২ বছর এবং ১ বছরের ৩ সন্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তিনিও এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সিতাই সীমান্ত দিয়ে শুরু হয় ভারতে মুক্তিকামী তরুণদের যাতায়াত। এ সময় তিনি ও তার স্ত্রী অবুঝ তিন সন্তান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে। নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন প্রশিক্ষণ ও ট্রানজিট ক্যাম্প এবং মুক্তাঞ্চল কালিগঞ্জ থানার কার্যক্রম। ওই ক্যাম্পে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার জাওরনির আব্দুল্লাহ (ডাকাত), রংপুরের ছাত্রনেতা হারেছ উদ্দিন সরকার, ছাত্রনেতা জামিরুল মুলক ও মাহাতাব উদ্দিন সরকার (বীর প্রতীক), ভুরুঙ্গামারীর কমান্ডার সামসুল হক, কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক তাজির উদ্দিন প্রামাণিক সংগঠিত হয়ে তৎকালিন দু’জন ইপিআর সদস্যের নেতৃত্বে মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে বাঙালি জওয়ানদের কুচবিহারে করিম উদ্দিন এমপি’র নিকট পৌঁছানো শুরু করেন। ওই সময় সেখানে আসা সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের রান্না-বাড়ার দায়িত্ব পালন করেন মাস্টারের স্ত্রী রেজিয়া খাতুন। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোদ্ধাদের পৌঁছে দেওয়া এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিজে গাইড দিয়ে নিজ বাড়ির ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়ে রাতের অন্ধকারে পথ প্রদর্শক হিসেবে বিভিন্ন টার্গেট মিশনে জীবনঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে দেওয়াই ছিল ইজ্জত আলী মাস্টারের রুটিন ওয়ার্ক। ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মারা যান। এখনও বেঁচে আছেন ইজ্জত আলী মাস্টারের সহধর্মিনী রেজিয়া খাতুন। বয়সের ভারে তিনি নাজুক।
তিনি জানান, হোসেন আলী নামের এক ডাক্তার (গংগাচড়া থানার লক্ষিটারী ইউনিয়নের সংগ্রাম কমিটির সভাপতি) যারা অসুস্থ হতেন, তাদের চিকিৎসা দিতেন। পরে তাদের ভারতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। মুক্তিকামী তরুণদের বসবাসের জন্য তার স্বামী বাড়ির সামানের লম্বা টিনের ঘর, দক্ষিণ দিকের দুটি টিনের ঘর ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করে ছিলেন। প্রতিদিন এই ক্যাম্পে ২০ থেকে ৩০ জন মুক্তিকামী তরুণকে রান্না করে খাওয়ানো, তাদের কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে দেওয়া ছিল রোজিয়া খাতুনের কাজ। আমাদের ক্যাম্পে অস্ত্র কম থাকায় প্রাথমিক ট্রেনিং শেষে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের আমার স্বামী রংপুরের হারেছ ভাইসহ অন্যান্যরা ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরতিকালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার এক একটি করে দল সাথে করে নিয়ে আসতো। মাস্টার সাহেব (ইজ্জত আলী) প্রায় প্রতিরাতেই আমাকে ৩ শিশু সন্তানসহ শয়নকক্ষে বাহির থেকে তালা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শত্রুদের স্থাপনা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য রাতের অন্ধকারে পথ-ঘাট চিনিয়ে দিতেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৫০০ টাকা প্রাপ্ত (চেক নং সিএ ০৩১৭৫০) হন।
ইজ্জত আলী মাস্টারের বাড়ির ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহনকারি রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সহকারি কমান্ডার, রংপুর জেলা আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধালীগের সাধারণ সম্পাদক, রংপুর জেলা সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের সাবেক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, ইজ্জত আলী মাস্টারের বাগানবাড়িতে আমি ১৫/১৬ দিন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তার স্ত্রী আমাদের রান্না করে খাইয়েছেন। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে আবার ওই বাড়িতে এসেই সম্মুখ সমরে গেছি। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে খেয়ে পড়ে ৩ জন বীরপ্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সেই সংগঠক ইজ্জত আলী মাস্টার ও তার স্ত্রীর কপালে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকুও মেলেনি। তার আগেই মাস্টার সাহেব মারা গেছেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়।
ওই বাড়িতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষদর্শী জামিরুল মুল্ক জানান, আমি হারেছ উদ্দিন সরকার বীরপ্রতীক, মাহাতাব উদ্দিন সরকার বীরপ্রতীক এর নেতৃতে ইজ্জত আলী মাস্টারের বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করি। অথচ সেই স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি নিয়ে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই।
ওই বাড়িতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন জানান, ওই সময় ইজ্জত আলী মাস্টারের বাড়ির ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারও ইজ্জত আলী মাস্টারের বাড়িতে আসতাম। ইজ্জত আলী মাস্টার আমাদেরকে বিভিন্ন অপারেশনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু সেই বাড়িটি এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা করা হয়নি। যিনি আমাদের আশ্রয় দিলেন, খাওয়ালেন পথ দেখালেন তিনিই স্বীকৃতি না পেয়েই মারা গেলেন। তার স্ত্রী এখনও বেঁচে আছেন। তাকে অন্তত মূল্যয়ন করা হোক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সিতাই থেকে রনাঙ্গন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন বীরমুক্তিযোদ্ধা খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল। ওই প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ও সাবেক সংসদ সদস্য জানান, আমার বিরুদ্ধে রংপুরে হুলিয়া হওয়ার পর আমি ভারতে যাওয়ার আগে ইজ্জত আলী মাস্টারের বাড়ির ক্যাম্পে ১৬/১৭ দিন ছিলাম। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষন নিয়ে সিতাই হয়ে ভারতে গিয়ে পত্রিকা প্রকাশনা করি। আমার মতো শত শত মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা ইজ্জত আলী মাস্টার ও তার স্ত্রীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য যখন তোমরা লেখালেখি করো, তখন আমার বলার ভাষা থাকে না।
কালিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রশিদুজ্জামান জানান, ইজ্জত আলী মাস্টার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা, আশ্রয়দাতা, লালনপালনকারী ছিলেন এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কেন এতদিনেও তিনি ও তার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান নি, এটা নিয়ে আমরাও লজ্জিত। স্মৃতি বিজরিত বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময় আবেদন নিবেদন করা হয়েছে। আশা করি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।
কালিগঞ্জের বাসিন্দা সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত হিসেবে সংরক্ষণের জন্য এলাকার মানুষের সাথে আমিও একমত। ওনার ব্যাপারে কারো কোন আপত্তিও নেই। বিষয়টি আমারও নলেজে আছে। তিনি সংগঠক ছিলেন। এ ব্যাপারে উদ্যোগ প্রয়োজন।