মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন ১০ বীর নারী

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:২৪

জাগরণীয়া ডেস্ক

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীর নারী। যদিও ১০ বীরাঙ্গনার ৪ জন ইতোমধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্প্রতি একটি গ্যাজেট প্রকাশ করার মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করে। এরফলে মুক্তিযুদ্ধে সব কিছু হারানো এই নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সুযোগ-সুবিধাসহ মর্যাদা পেতে যাচ্ছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১০ বীর নারীর মধ্যে বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা ও সুষমা সূত্রধর রোগাক্রান্ত হয়ে অভাব-অনটনের সংসারে উন্নত চিকিৎসার অভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোনোমতে বেঁচে আছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমণি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল।
 
একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রণার পর থেকেই সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। তখন পাকবাহিনী গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ওই দিন পাক বাহিনী “জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়” বলে গোবিন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারণ পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামী জনতাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এ সময় নারীরা স্বামী সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানিয়েও পাকিস্তানি বাহিনীর মন গলাতে পারেননি। উল্টো পাক-জান্তারা নারীদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন।

মুক্তিযোদ্ধা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবি (পাকিস্তানি সেনা) আসে তখন আমরা স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবিরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়।

তিনি আরও বলেন, আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিন মজুরের কাজ করে। আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাবো না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। এই সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যা রাণী পাল (৭০) বলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবিরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের (পাত্র) ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করি। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবিরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক-বাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে।

তিনি বলেন, আমাদেরকে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ধন্যবাদ। স্বামী হারানোর পর থেকে ৪৭টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সকল সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদেরকে দেওয়া হয় তাহলে যে কদিন বাঁচি প্রশান্তি আর সম্মানের সাথে বাঁচতাম।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত