প্রবাসিনীর চোখে মিলিনিয়াম দশকের ঢাকা-২
প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০১৭, ২৩:২৯
লেখালেখির জন্য ব্লগ মাধ্যমটিও এই সহস্রাব্দে এসে ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সামহোয়ারইন নামক বাংলা ব্লগটি প্রথম বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতিষ্ঠিত ব্লগ। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক সাংবাদিক প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অন্তর্জালেও লেখালেখি শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, হাই ফাইভ, অর্কুট, টুইটার, গুগল বাজ এগুলোর বিশদ ব্যবহার ঢাকাবাসী শুরু করেন। মোবাইলের মাধ্যমে অন্তর্জাল ব্যবহার করাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসময়। মিলা, তিশমা, আনুশেহ, শাহরিয়ার জয়, অর্ণব, বাপ্পা, পার্থ, হাবিব, বালাম, তপু, তাহসান এরা সেসময়ের জনপ্রিয় গায়ক গায়িকা। দেশি কাপড় ব্যবহার করে দেশে তৈরী পোশাক তখন তারকাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। ফ্যাশন হাউজ রঙ, ড্রেসিড্যাল, ইনফিনিটি, স্মার্টেক্স, বাংলার মেলা, মায়াসীর, দর্জি, মান্ত্রা এরা নিজেদের ডিজাইনের স্বাতন্ত্র্যের কারণে মধ্যবিত্তের মন কাড়েন। মধ্যবিত্তকে ভারত থেকে বাংলাদেশমুখী করে তুলেন এই ফ্যাশন হাউজগুলো। অনেকে বিয়ের উৎসবের জন্যেও দেশি ফ্যাশন হাউজের ওপর নির্ভর করতে লাগলেন।
পাটিয়ালা সালোয়ার নামক অনেক কুচি দেয়া পাঞ্জাবী সালোয়ার ২০০৪–২০০৫ এর দিকে খুব জনপ্রিয় ছিল। আবার সেই সময় ওপরে কলার তোলা বান্টি বাবলী কামিজের ডিজাইনও হট কেক ছিল। যদিও বিভিন্ন সময় ভীর জারা থ্রিপিস, লক্ষ্ণৌ চিকেনের কাজ করা থ্রিপিস, চুন্দরী থ্রিপিস, কটকী থ্রিপিস ঘুরে ঘুরে ফ্যাশনে ছিলো। এ সময়ে কিশোরী তরুণীদের কাছে জিন্স ফতুয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক ছেলেরা অলঙ্কার পরা শুরু করেন এ দশকে। হাতে নানা ধরনের ব্রেসলেট, গলায় মালা সহ অনেককেই দেখা যেতো। অনেক ছেলেই রঙিন পাঞ্জাবী ও ফতুয়া পরতেন।
গয়নায়ও আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। হাল ফ্যাশনের গয়নার পরিবর্তে আগের দিনের ভারী ভারী সেকেলে গয়নার ডিজাইন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রূপোর গয়নায় সোনার জল দিয়ে তাতে নানা রঙের ম্যাচিং পাথর বসিয়ে মেয়েরা পরতে লাগলো। সোনার বদলে রূপা হয়ে ওঠলো মধ্যবিত্তের অলংকার। বিয়ের সাজেও আগের মতো প্রচুর ফেস পেন্টিং বাদ গেলো। হাত ভর্তি করে কনুই পর্যন্ত মেহেদী দেয়া হতো বিয়ের কনেদের। অনেকে পায়েও দিতেন। কনেরা লালের পাশাপাশি অন্য রঙের কাপড়ের ব্যবহার শুরু করলেন বিয়েতে। অনেক সময়ই দেখা যেতো বর কনে রঙের সামঞ্জস্য করেই কাপড় পরেছেন। বরদের শেরোয়ানী, পাগড়ী প্রভৃতিতে মুম্বাইয়ের লেটেস্ট মডেলের ছাপ দেখা যেতো। বিয়েতে আলাদা আলাদা কোনে ছেলে মেয়েকে আলাদা করে বসানোর পরিবর্তে, বরকনেকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানোর রেওয়াজ শুরু হলো। গায়ে হলুদে গান নাচের প্রচলন হয় ব্যাপকভাবে। মধ্যবিত্ত মেয়েরা প্রচন্ড ত্বক, রূপ সচেতন হয়ে ওঠে সে সময়। প্রায় প্রতি পাড়ায় মোড়ে বিউটি পার্লার দেখা যেতো এসময়টায়।
অনেক মধ্যবিত্ত মেয়েরা নিজেরাও এ ব্যবসার প্রশিক্ষন নিয়ে বিউটি পার্লার চালাতে উদ্যেগী হন, তাতে করে বিউটি পার্লার মানেই চাইনিজ কিংবা হংকং এ ধারনাটা পালটে যায়। ক্লান্তিময় নগরজীবন থেকে অব্যহতি পেতে অনেকেই ঈদের ছুটিছাটায় সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবনে বেড়াতে যেতেন।
মোবাইলের ব্যবহারের কারণে কিংবা অন্তর্জালের সহজলভ্যতার জন্যেই হোক আশঙ্কাজনকভাবে পরকীয়া প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এজন্য অনেকে সন্তানের জীবন নিতেও পিছপা হননি। সাহসী কিছু ছেলে মেয়ে এসময় লিভ টুগেদার করতেন। ইভ টিজিং এর ঘটনায় মেয়েদের আত্মহত্যার হার যেকোন দেশের যেকোন কালের রেকর্ড ছাড়ায়। কিন্তু সবচেয়ে আর্শ্চয্যের ব্যাপার হলো এ নিয়ে সুশীল সমাজ বিশেষ করে মহিলা মহল একেবারেই চুপচাপ ছিলেন। তাদেরকে কোন ধরনের মানব বন্ধন, প্রতিবাদ সভা, নিদেনপক্ষে পত্রিকায় দু একটা কলাম লিখতেও দেখা যায়নি।
২০১০ সালের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে পূর্ববর্তী সরকার থেকে পাওয়া ১৬৮ কাঠা আয়তনের সুরম্য প্রাসাদ থেকে সেনাবাহিনী বের করে দেন। জননেত্রী কেন সেনাবাসে থাকবেন এবং প্রচণ্ডো ধনী হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি সরকারী সম্পদ এখনো ভোগ দখল করবেন এই ছিল তখনকার সবার যুক্তি। ২৯শে নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ে তিনি আইনি লড়াইয়েও হেরে যান এবং বাড়িটির দাবী তাকে আপাতত ছাড়তে হয়।
লেখক: প্রবাসী লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী