প্রবাসিনীর চোখে মিলিনিয়াম দশকের ঢাকা-১
প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০১৭, ২৩:১৭
২০০০ সালে নতুন দশকের সাথে সূচনা হয় নতুন সহস্রাব্দের। সারা পৃথিবী জুড়ে এ নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নিরানব্বই–দুই হাজারে বাংলাদেশের অনেক দোকানপাটের নাম হয় এই অনুসারে। ঢাকার নিউমার্কেটে চলে আসে 'মিলিনিয়াম বিরানী হাউজ'। নামকরণের এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে ইউনিক। চাইনিজ রেষ্টুরেন্টের নাম 'ম্যাকডোনাল্ডস', চুল কাটার দোকানের নাম 'কাসাব্লাংকা হেয়ার কাটিং', জিগাতলায় আছে 'সুনামী রেষ্টুরেন্ট'। যেকোন জিনিস যে কারনেই আলোচিত তার দ্বারাই কিছু না কিছু দেশে নামাংকিত। বুশ আর সাদ্দামের যুদ্ধের কারণে সে সময়কার জন্মানো প্রচুর ছেলে শিশুর নাম 'সাদ্দাম'। আর একটি জিনিস আমার বাংলাদেশের খুব মনে ধরে রাস্তার দুপাশে মনোরম সব বিলবোর্ড। এ জিনিসটি আমি খুব একটা বাইরে দেখিনি দক্ষিণ এশিয়া বাদে। পশ্চিমে থাকে খুবই ছোট সাইজের সামান্য বিজ্ঞাপন, কিন্তু প্রকট রঙ ব্যবহার করে, পেল্লায় সাইজের এই বিলবোর্ড একান্তই দক্ষিণ এশিয়ার গৌরব।
অথচ এই গৌরবোজ্জল সহস্রাব্দের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে খুবই কলঙ্কজনকভাবে। থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে অনেক ছেলেদের পাশাপাশি কিছু মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বের হয়েছিল। সেখানে 'বাঁধন' নামে এক তরুণীকে প্রকাশ্যে লাঞ্চিত করা হয়। যার কারণে তার ব্যক্তিগত জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, তার সেই সময়ের বাগদত্তা তাদের বাগদান ভেঙ্গে দেন। ২০১০ সালে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় সেই দিনের সব অপরাধীকে আদালত মুক্তি দেন। সমন জারী করা সত্ত্বেও একদিনও বাঁধন আদালতে আসেননি, শুনানিতে কিংবা সাক্ষ্য গ্রহণে অংশগ্রহণ করেননি। পৃথিবী জুড়ে যে সহস্রাব্দের সূচনা হয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে, সেখানে বাঁধন নিজের ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়টুকুর প্রতিবাদ করার সাহস পাননি নিজ দেশে।
এই দশকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে তার ডাবল হ্যাট্রিক অর্জন করে বিশ্ব জোড়া অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন থাকে। মধ্যবিত্তের জীবন ধারায় প্রভূত পরিবর্তন ও উন্নতি দেখা যায়। প্রায় বাড়িতেই রঙিন টিভি, ডিপ ফ্রিজ, এসির মতো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়। প্রায় সবার হাতে হাতেই মোবাইল। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার মোবাইল–টিভি এগুলো তখন মধ্যবিত্ত নয় নিম্নবিত্তের হাতে পৌঁছে গেছে। প্রায় প্রতি মধ্যবিত্ত ঘরেই কম্পিউটার বর্তমান। এবং আধুনিক জেনারেশন ব্যাপকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারও করছেন। আগের মতো সিদ্ধ করে পানি ছেঁকে ঢালার পরিবর্তে বাড়িতে বাড়িতে ফিল্টার মেশিনের প্রচলন হয়। ঢাকায় বসুন্ধরা- শর্পাস ওয়ার্ল্ড এর মতো শপিং মল এসেছে মধ্যবিত্তের জীবনে। সারা গুলশান–ধানমন্ডি ভরে গেছে বাহারি ইংরেজী, বাংলা নামের আধুনিক ও অভিজাত রেস্টুরেন্টে। বিশ্ববিখ্যাত ফাস্ট ফুড চেইন কেন্টোকী ফ্রাইড চিকেন, পিজা হাট বাংলাদেশে তাদের প্রথম দোকান খুলেন গুলশানে। বুমারস এর মতো রেস্টুরেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিংস বেকারী ব্রাউন ব্রেড নিয়ে আসেন ঢাকার বাজারে। আগে মাছওয়ালা, মুরগীওয়ালা শুধু বিক্রি করেই চলে যেতেন। এখন তারাও বাড়তি সেবা প্রদানে মনোযোগী হয়েছেন। বিক্রির পর মাছ– মুরগী কেটে দিয়ে যান। সারা দেশ জুড়েই ফার্মের মুরগী খাওয়ার প্রচলন হয় দেশি মুরগীর পাশাপাশি।
এই দশকে আবারো জলপাই রঙধারীরা প্রায় দুবছর দেশ শাসন করেন। বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে এই দশকে। বিদ্যুৎ সমস্যা, পানির সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অসহ্য যানজট নিয়ে চলেছে এই দশকের মধ্যবিত্তের জীবন। বিদ্যুৎ সমস্যার আপাত সমাধান বের করেন মধ্যবিত্তরা আইপিএসের মাধ্যমে। শনির আখড়ায় ২০০৬ সালে অতিষ্ঠ এলাকাবাসি তাদের জনপ্রতিনিধিকে ধাওয়া করেন এক পর্যায়ে। বাংলা ভাই নামের এক সন্ত্রাসীর উত্থান ঘটে এবং হাজার নাটকের মাধ্যমে তাকে সরকার গ্রেফতার দেখিয়ে এই নাটকের আই ওয়াশ সমাপ্তি ঘটান। একযোগে ৬৩টি জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও এ দশকেই ঘটে। ২১শে আগস্ট ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ঘটনার তদন্ত কাজ চলছিল। তবে এই দশকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামীদের সাজা হয় আর জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। রমনা বটমূলে নতুন বছরের প্রথম প্রহরে সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা করে। বোমা বিস্ফোরণ, বিল্ডিং ধসে মৃত্যু, অগ্নিকান্ডে মৃত্যু, হত্যা সর্বোপরি অপমৃত্যুর হার এই দশকে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়ায়। যারই অপমৃত্যু হোক না কেনো, যেকোন কারণে তার সুবিচার পাওয়া বাংলাদেশে অসম্ভব এটাও এই দশকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
আনিসুল হকের লেখা আর মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এর পরিচালনায় ব্যাচেলর নামক ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয় মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে। ব্যাচেলর সিনেমার ভাষারীতির দ্বারা তরুণ সমাজ ব্যাপক প্রভাবিত হন। প্রমিত ভাষার পরিবর্তে উঠতি লেখকরাও ফারুকী ভাষা ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নগর জীবনে, স্কুল কলেজে, নাটকে, সিনেমায় এই ভাষাটির প্রচলন শুরু হয়। সুশীল সমাজে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের জীবনের কোথাও এই ভাষারীতিটি রয়ে যায়। তিশা, শ্রাবন্তী, তিন্নি, প্রভা, অপূর্ব, শাহেদ, হাসান মাসুদ, অপি করিম এরা এসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী। আনিসুল হকের লেখা ধারাবাহিক ৬৯, ৫১, দৈনিক তোলপাড় মধ্যবিত্তের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পায়। সেই সময় নাটকেরও গ্রুপ তৈরী হয়। হুমায়ূন আহমদের গ্রুপ, সালাহউদ্দিন লাভলু গ্রুপ, আনিসুল হক গ্রুপ ইত্যাদি। প্রত্যেক গ্রুপের কিছু ফিক্সড অভিনেতা অভিনেত্রী ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ মানেই শাওন, সালাহউদ্দিন লাভলু মানেই তানিয়া আর ফারুকী মানেই তিশা। এ সময়ের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক ছিল ৪২০, লাবণ্যপ্রভা, রঙের মানুষ।
(চলবে)
লেখক: প্রবাসী লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী