তুমি এখন বড় হচ্ছো: পর্ব ২
প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০১৮, ২৩:৩১
‘তোমার অস্তিত্ব বোধ’ অধ্যায়ের সাতান্ন পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “এতোদিন তুমি ছোট্ট ছিলে, পরিবার বা পরিবেশ সম্পর্কে অতো বেশি সচেতন ছিলে না, থাকার দরকারও ছিলো না, কিন্তু এখন তুমি বড় হচ্ছো, এখন তোমার সচেতন হবার সময় এসেছে। আগে হয়তো খালি গায়ে, খালি পায়ে রাস্তায় নেমে বস্তির ছেলেমেয়েদের সাথে ডাংগুলি খেলতে, এখন আর ইচ্ছে হলেও তা করতে পারছো না। তোমাকে ভাবতে হচ্ছে নিজের সম্পর্কে। তুমি আর আগের মতো মিশতেও পারছো না যার তার সঙ্গে”।
এমন বিদ্বেষমূলক শিক্ষনীয় (!) বই বাংলাদেশে চলাই সম্ভব। বস্তির ছেলেমেয়ে, যার তার এর মতো শ্রেণী বৈষম্যমূলক কথাবার্তা বইতে লিখে কিশোর কিশোরীদের হাতে যিনি তুলে দিচ্ছেন তিনি একজন অনুশীলনরত মনোবিজ্ঞানী। তারপরও আমরা একটি সংবেদনশীল, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম আশা করে যাবো। সেটি আমাদের নিজেদেরকে তৈরী করত হবে না, সেটি আকাশ থেকে এমনি টুপ করে পড়ে যাবে আশা করছি।
‘তোমার যৌন কাতরতা’ অধ্যায়ের তিরাশি পৃষ্ঠায় তিনি কিশোরীদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, “মানুষের শরীর হচ্ছে পবিত্র এক মন্দিরের মত। এ শরীরও পূতপবিত্র মনে আরতি করতে হয় অর্থাৎ শ্রদ্ধা জানাতে হয়, সে শ্রদ্ধা জানাবে তুমি। শারীরিক সম্পর্ক সামান্য একটু এগোলেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শুরু হবার সময় মনে হয় যেন কি-না-কি হয়ে যাবে, বুঝি পৃথিবীটাই হয়ে যাবে ওলোটপালট। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, মানুষের শরীর এক বদ্ধ জলাশয়, একটুতেই এর জল ঘোলা হয়ে ওঠে। যদি না প্রতিদিন তুমি এর তলা থেকে কাদা–পাঁক তুলে ফেলে দাও। পবিত্র শরীর হচ্ছে তোমার এ্যাসেট বা সম্পদ”। এরকম আরও বহু কিছু লিখেছেন, আমি সামান্য একটু উল্লেখ করলাম মাত্র।
এই বয়সে কিশোরীরা প্রাকৃতিকভাবেই শরীর নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত থাকে। নানা ছোট ছোট কারণে এরা নিজেদেরকে বড় বড় আঘাত করে, নিজেদের ক্ষতি করে, অনেক সময় আত্মহননের মত সিদ্ধান্ত নেয়। সামাজিক কারণে অভিভাবকরাও পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে। সে জায়গায় একজন লেখিকা ও মনোবিজ্ঞানী যদি তাদেরকে আশা’র কথা শুনিয়ে তাদের ভেতরের শঙ্কা বা হতাশা দূর না করে উলটো মধ্যযুগীয় আবেগীয় কথাবার্তা দিয়ে তাদের আবেগ উস্কে দেয় তাহলে অঘটন বন্ধ করে আশার কথা শোনাবে কে? জীবন চলে জীবনের মত, ছোঁয়াছুয়িতে জীবন শেষ হয়ে যায় বুঝি? সেটা তবে বিশ্বব্যাপী না হয়ে শুধু ভারতবর্ষেই হতে হবে কেন? কিংবা মুসলিম বিশ্বে? এসব কিন্তু এক অর্থে ‘অনার কিলিং’ এর প্ররোচনা। লেখিকা প্রায় আট বছর বিলেত বাস করেছেন কিন্তু তার লেখায় বৈশ্বিক ব্যাপারটা প্রায় অনুপস্থিত। হয়ত তিনি বইটির অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে যেসব মধ্যবিত্তীয় মানসিকতার কথাবার্তা লিখলে অভিভাবকরা খুশি হয়ে বইটি বাচ্চাদের পড়তে দেবেন, সেই সব কিছুই লিখে গেছেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটির কথা মনে পড়লো। বইটিতে কয়েকবার একটি লাইন ঘুরেফিরে এসেছে, “পাকিস্তানি সেনারা যখন আমাদের পেয়েছে তখন আমরা রাজাকারদের উচ্ছিষ্ট” --- পুরো বইটির মধ্যে এই লাইনটি আমার কাছে যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। লেখিকা কেন এই ধরনের শব্দ চয়ন করেছেন, তিনি জানেন। একজন জীবন্ত মানুষ কী করে উচ্ছিষ্ট হতে পারে? যতো শারীরিক লাঞ্ছনাই তিনি ভোগ করে থাকুন। একজন প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখিকা যিনি হৃদয় দিয়ে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্যে দিন রাত এক করে খেটে গেছেন তিনি কী অন্য কোন শব্দ চয়ন করে এই পারিপার্শ্বিকতার ছবিটা আঁকতে পারতেন না? কোন মানুষ সর্ম্পকে এ ধরনের কথা ভাবতে আমার হৃদয় মানে না। মানুষের দেহ কি খাদ্য বস্তু? শারীরিক কারণে কেউ কি উচ্ছিষ্ট হতে পারে? পারে ক্ষতিকর স্বভাব চরিত্রের কারণে যেমন রাজাকাররা।
‘তোমার লেখাপড়া’ অধ্যায়টি আমার ভাল লেগেছে। “তুমি এখন বড় হচ্ছো, তুমি স্কুলে যাও নিয়মিত, তোমার ওপরে লেখাপড়ার চাপ পড়েছে বেশি, ক্লাসের পড়া ছাড়াও তোমাকে স্কুল শেষে আলাদা কোচিং নিতে হয় পরীক্ষায় ভালো করার জন্যে, রেজাল্ট ভালো হলে ভর্তি হবে তুমি বিজ্ঞান শাখায়, আর খারাপ হলে মানবিক-এ। তুমি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলে তোমার অভিভাবকরাও মাথা থাবড়ে বেড়াবেন দুঃখে, কারণ তাদের ধারণা কেবল বুদ্ধিমান ছেলেরাই বিজ্ঞান পড়ে আর গবেটগুলো পড়ে মানবিক-এ। নিজের কথা ভুলে, অভিভাবকদের কথা চিন্তা করেই তুমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছো পড়াশোনা করার অতিরিক্ত বোঝা, যা তোমার ছোট্ট কাঁধটাকে মাঝে মাঝেই বাঁকিয়ে নিচু করে ফেলে”।
এখানে লেখিকা বাচ্চাদেরকে নিজেদের পছন্দের বিষয় নির্বাচন করতে, সর্তক হতে, কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে, ভবিষ্যত গড়ে তুলতে বেশ কিছু বাস্তবধর্মী উপদেশ দিয়েছেন। শুধু বাবা-মায়ের নয় নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়েও ভাবতে বলেছেন। পড়াশোনায় যারা মাঝারি তারা তাত্ত্বিক পড়াশোনার বাইরে, ব্যবহারিক বিষয়গুলো’র প্রতি মনোযোগ দিতে পারে, সেসব নিয়েও বেশ আকর্ষণীয়ভাবে লিখেছেন।
আঠারোটি অধ্যায়ে ভাগ করে চুরানব্বই পৃষ্ঠার সুধীজন প্রশংসিত, কিশোর কিশোরীদের জন্যে লিখিত মনোবিজ্ঞানের বইটি পড়ে কিছুটা হতাশ হয়েছি তো বটেই।
তারপরেও বলবো, বাংলাদেশের সামাজিক ট্যাবুতে এখনও অনেক পরিবারে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে আছে যারা জীবনের এই কঠিন সময়টা নিয়ে নিজেরা আলোচনা করতে বা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। জীবনের অনেক সহজাত ও স্বাভাবিক জিনিস এড়িয়ে যায়। বাংলা ভাষায় এই নিয়ে লেখাও হয়েছে খুব সামান্য। সেদিকটা বিবেচনা করলে যাদের বাড়িতে এগারো থেকে পনের বছর বয়সী বাচ্চা আছে, তাদের পরিবারের বাবা-মা এবং বাচ্চাদের সবারই এই বইটা পড়ে নেয়া ভাল। ইউরোপের স্কুলগুলো এ ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য করে, সে প্রত্যাশা তো দেশে নেই তাই কিছু না থাকার মধ্যে এটিই থাকা।