বই রিভিউ

তুমি এখন বড় হচ্ছো: পর্ব ১

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০১৮, ২৩:০৪

মনোবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক রচিত ‘তুমি এখন বড় হচ্ছো’ পড়লাম। তিনি বাংলাদেশের প্রয়াত বিখ্যাত কবি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিনী। আনোয়ারা সৈয়দ হক নিজের লেখালেখি’র জন্যে বাংলা ভাষায় অনেকের শ্রদ্ধাভাজন ও নমস্য। চিকিৎসক হিসেবে ব্যস্ত দিন কাটানোর পরও সাহিত্যের প্রতি তার এই অকৃত্রিম টান, নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। উঠতি বয়সের বাচ্চাদের মানসিক জগত, তাদের দ্বিধা দ্বন্দ্ব, জানা না জানা প্রশ্ন উত্তর নিয়ে লেখা এই বইখানা। বইটি পড়তে পড়তে কিছু কিছু জায়গায় এতটাই খটকা লাগলো যে না উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। একজন কথাসাহিত্যিক এরকম একটা জটিল ব্যাপার নিয়ে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে বই লিখেছেন যেটি সামাজিকভাবে জনপ্রিয়ও হয়েছে, সেটা আমাকে রীতিমতো পীড়া দিচ্ছে। তার মত বিখ্যাত অবস্থানের উঁচুতলার কারো সমালোচনা করা আমার মত কারো জন্যে ধৃষ্টতা তো বটেই কিন্তু মনের খরখর যায় না কিছুতেই। 

বইটির চার নম্বর অধ্যায় ‘তোমার শরীরের সৌন্দর্য’ পৃষ্ঠা নম্বর আটাশ, সেখানের একটি অংশে লেখা আছে “প্রতিটি বংশের নিজস্ব কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে থাকে, যা অন্য কারো থাকে না। তোমার গায়ের রঙ সাহেবদের মতো হবে, নাকি আবলুস কাঠকেও লজ্জা দেবে, এসবই কিছুটা ভাগ্যের খেলা আর বেশির ভাগই বংশগতির খেলা, সুতরাং এর কোনটার ওপরে তোমার হাত নেই”। 

ছয় নম্বর অধ্যায়ের নাম ‘টানাপোড়েন আর টানাপোড়েন’ পৃষ্ঠা নম্বর সাইত্রিশ, “যদি কুৎসিত কোন মানুষ সত্যি সত্যিই জানতো সে দেখতে কুৎসিত, তাহলে অবশ্যই ভালো জামাকাপড় পরা বা প্রসাধন করা ছেড়ে দিতো, চারখানা গামছাই হতো তার দিন-রাতের পরিধানের সম্বল, মুখের দাড়ি-গোঁফ কামাবার প্রয়োজনই মনে করতো না। খামোখা পয়সা খরচ করবে কেন। এমনকি যে মানুষের মাথায় চুল নেই, যার দাঁত নড়বড়ে বা যার রঙ আবলুস কাঠের মতো কালো বা যার মাজা তিন মাইল চওড়া, সে পর্যন্ত নিজেকে আয়নায় সুন্দর দেখে”। 

বেশিরভাগ মানুষই লেখালেখি করেন নিভৃতে, একান্তে। নিজের অজান্তেই সেখানে ভেতরের ভাবনাগুলো বেরিয়ে আসে, শালীনতা, ভদ্রতা বা সুশীলতা দিয়ে তা সব সময় চেপে রাখা যায় না। বইটি লেখা হয়েছে এগারো থেকে পনের বছরের বাচ্চাদের জন্যে যারা বয়ঃসন্ধি’র সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। দুই হাজার বারো সাল অব্দি এটি’র ষষ্ঠ মুদ্রণ হয়েছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো বাচ্চারা যদি গায়ের রঙ নিয়ে আগে চিন্তা না-ও করতো এই বই পড়লে তারা চিন্তিত হয়ে যাবে।  গায়ের রঙ মানেই ‘সাহেব আর আবলুস’ এর বাইরে বা মাঝামাঝি কিছু নেই? একজন কথা সাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী যদি এ ধরনের বর্ণ বিদ্বেষ লালন করেন তাহলে বাকিদের কথা বলা বাহুল্য মাত্র। গৌড় বর্ণ মানেই সাহেব? উঁচু কিছু? আবলুস মানেই খারাপ? কালোদের মাঝে সৌন্দর্য নেই? সাঁওতাল কিংবা কঙ্গো’র মানুষদের দেখেছেন কখনো চোখ মেলে? 

হুমায়ূন আহমেদ তার কোন এক বইয়ে লিখেছিলেন, কিংবা এলেবেলে সিরিজে, বাঙালি ছাপার অক্ষরে যা পড়ে তাই বিশ্বাস করে ফেলে। সে দিক থেকে ভাবলে এই বইয়ের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এমনিতেই বাংলা সাহিত্য জুড়ে শুধুই সৌন্দর্যের বর্ণনা, শ্যামকালিয়া ‘কৃষ্ণ’কে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যে কোন কালো বর্ণের কোন প্রখ্যাত নায়ক নায়িকাই নেই। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য কালো বর্ণের নায়িকা নিয়ে কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি”। যদিও তাঁর নিজের উপন্যাসের নায়িকারা সৌন্দর্যের দিক থেকে অপ্সরীর কাছাকাছিই থাকতো।   

কিশোরী বয়সে পড়েছিলাম বুদ্ধদেব গুহের ‘বাবলি’, মোটাসোটা শ্যামলা তরুণী’র সাথে প্রেম হয়েছে এক চৌকষ আইএস অফিসারের। বাবলি নিজেও মেধাবী, ভাল টেনিস খেলে, সেও ভাল চাকরি পেয়েছে। কিন্তু প্রেম হয়ে যাওয়ার পর সে বাংলার লেখকদের কল্পনার চিরাচরিত নারী হয়ে গেলো, নিজেকে সুন্দরী করে প্রেমিকের সামনে উপস্থাপনে ডায়েট আর ব্যায়ামে লেগে গেলো, ঐদিকে পুলা কিন্তু আছে ঠিকঠাক নিশ্চিন্তে। যে বই পড়ে কিশোরি বয়সে মুগ্ধ হয়েছি সে বই পড়েই আবার পরে বিরক্ত হয়েছি। এমন ছাগল কেমনে ছিলাম, সব কিছুতেই মুগ্ধ কেমনে হইতাম তা নিয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়েছি।  

(চলবে…)