জীবনের নিরাপত্তায় পাকিস্তান ছাড়তে চান আসিয়ার স্বামী

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:২৬

অনলাইন ডেস্ক

পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন উল্লেখ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র অথবা কানাডায় আশ্রয় পাওয়ার আবেদন করেছেন ব্লাসফেমি আইনে পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসিয়া বিবির স্বামী আশিক মসিহ।

৩ নভেম্বর (শনিবার) জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে আশিক মসিহ বলেন, তিনি এবং তা পরিবার খুবই আতঙ্কে আছেন। আমি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন তিনি আমাদের সাহায্য করেন এবং যদি সম্ভব হয় আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা এখান থেকে ওখানে শুধু পালিয়ে বেড়াচ্ছি, বারবার অবস্থান বদলাচ্ছি আমরা।

 প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসিয়া বিবির আইনজীবী সাইফ মুলুকও দেশত্যাগ করেছেন।

এদিকে, আসিয়া বিবির মুক্তির রায় ঘোষণার পর থেকেই বিক্ষোভ চলছে পাকিস্তান জুড়ে।  চলমান বিক্ষোভ সামলাতে কট্টরপন্থি ইসলামিস্ট দল তেহরিক-ই-লাবাইক পার্টির (টিএলপি) সঙ্গে শনিবার একটি সমঝোতায় পৌঁছায় দেশটির সরকার। সমঝোতার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে আসিয়া বিবির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে কতদিনের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা, তা এখনো জানানো হয়নি। এছাড়াও সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা আসিয়াকে খালাস দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে।

এ প্রসঙ্গে আসিয়ার স্বামী  আশিক বলেন, এই সমঝোতার কথা শুনে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের কাঁপুনি বয়ে গেছে। বিচার বিভাগের ওপর এভাবে চাপ প্রয়োগ করা সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক না। 

উল্লেখ্য, গত ৩১ অক্টোবর (বুধবার) পাকিস্তানে ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবির সাজা বাতিল করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ইসলামী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ ও বিচারপতিদের হত্যা করার হুমকির মধ্যেই প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ যুগান্তকারী এই রায় ঘোষণা করেন।

আসিয়া বিবির মৃত্যুদণ্ড বাতিলের সিদ্ধান্তটি তিন সপ্তাহ আগেই নিয়েছিলেন বিচারপতিরা। তবে ইসলামী সংগঠনগুলোর হুমকি-ধামকির কারণে রায় ঘোষণা পিছিয়ে যায়। বিচারপতিরা জানান, আসিয়া বিবি দোষ করেছেন এমন কোনও শক্ত প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত হয়নি। পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে দ্য গার্ডিয়ান জানায়, যে তিনজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়েছে তারাও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিসার বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো খারিজ করা হচ্ছে। অন্য কোনও অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়োজন না পড়লে তিনি অবিলম্বেই মুক্তি পাবেন।’

চরম ডানপন্থী পাকিস্তানি রাজনৈতিক দল তেহিরক-ই-লাব্বাইক (টিএলপি) দীর্ঘদিন ধরেই ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। তাদের নির্বাচনী প্রচারণার মূল বিষয় হচ্ছে ধর্ম অবমাননার শাস্তি নিশ্চিতে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়া। সালমান তাসিরের হত্যাকারীকে তারাই বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এই সংগঠন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আগে থেকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলো। তাদের বিবৃতির ভাষ্য,‘তাকে যদি বিদেশে হস্তান্তর করার কোনও চেষ্টা করা হয় তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর।’

এদিকে পকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে দেশটির বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ও সংগঠনসমূহ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই রায়কে পাকিস্তানের বিচার বিভাগের সাহসিকতামূলক পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছে।

২০১০ সালে পাকিস্তানের ধর্ম অবমাননা সংক্রান্ত আইনে দেশটির প্রথম নারী হিসেবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। এমনকি পাকিস্তানেও তার পক্ষে দাঁড়ান অনেকে। তবে এদের মধ্যে অন্তত দুই জনকে তাদের অবস্থানের কারণে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আসিয়া বিবির পক্ষে কথা বলায় পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে তারই দেহরক্ষী হত্যা করে। আর সেই দেহরক্ষীকে পাকিস্তানে বীর হিসেবে সমাহিত করা হয়।

সেদিনের ঘটনা:
৪৭ বছর বয়সী খামার শ্রমিক আসিয়া তিন সন্তানের জননী। ২০০৯ সালে খামারে কাজ করার সময় এক গরমের দিনে মুসলিম শ্রমিকদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে পানি খাওয়ায় তার মুসলিম সহকর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা দাবি করে, আসিয়া যেহেতু মুসলিম নন, সেক্ষেত্রে গ্লাসটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে, সেটি ব্যবহার করা যাবে না। আসিয়াকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দাবি জানায় তারা। তা প্রত্যাখ্যান করেন আসিয়া। সেসময় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে মুসলিম শ্রমিকরা দাবি করে, আসিয়া বিবি নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। আসিয়া বিবি বরাবরই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেছেন বলে স্বীকার করলেও তার দাবি, তিনি ধর্ম অবমাননাকর কিছু বলেননি।  তবে ব্লাসফেমি আইনে দোষী সাব্যস্ত খ্রিস্টান এ নারীকে ২০১০ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয় লাহোর হাইকোর্ট।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনকে ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ধর্ম অবমাননার অভিযোগগুলো উঠলেই এমন আবেগ দেখা যায় যে কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করে অভিযোগ ভুল প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট আইনটিতে ধর্ম অবমাননার সংজ্ঞাই স্পষ্ট নয়। তাছাড়া অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ হাজির করাও মুশকিল। কারণ সেরকম ক্ষেত্রে নতুন করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠতে পারে। পাকিস্তানে অনেক মানুষ ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

২ নভেম্বর (শুক্রবার) তৃতীয় দিনের মতো দেশটির রাউয়ালপিন্ডি, করাচিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ করেছে কট্টরপন্থিরা। আসিয়া বিবির কুশপুত্তলিকা দাহ করাসহ নানাভাবে এ রায়ের সমালোচনা করেছেন তারা।