নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নেতাদের
প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:০৭
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৪টি পুলিশ পোস্টে ‘বিছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গাদের’ হামলায় কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৫ পুলিশ সদস্য ও ৭ জন বিছিন্নতাবাদী ছিল। এ হামলার জন্য স্থানীয় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে (এআরএসএ-আরসা) দায়ী করে মিয়ানমারের সরকার। এরপরেই মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এই সহিংসতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে। বিশেষ করে গ্রামের চেয়ারম্যান, ধনী ব্যক্তি এবং স্থানীয়দের কাছে যারা ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত তাদের টার্গেট করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে। এরপর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মগ সম্প্রদায়ের লোকজন নৃশংসভাবে হত্যা করে সেইসব ছবি ও ভিডিও সাধারণ রোহিঙ্গাদের দেখিয়ে গ্রামগুলোয় ভীতি সৃষ্টি করছে। যাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা পালিয়ে যায়।
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর মংডুর জমিদে লম্বাগুনা এলাকার মো. আলম (২৫) পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। নাফ নদীর পাশে জেলে পাড়া সংলগ্ন বরফ কলের সামনে বসে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন,‘আমাদের বাড়ি জমিদে লম্বাগুনার পাতন ঝাঁ এলাকার মুন্নিপাড়া গ্রামে। আমরা আত্মীয়-স্বজন মিলে ৩৩ জন গত ১২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) সকালে নাফ নদী পার হয়ে এসেছি।’ আলমের পাশেই বসে ছিলেন তার বাবা সালেহ আহমেদ। মিয়ানমারে রেখে আসা গরুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। কয়েকজন জেলে এক দালালের মাধ্যমে গরু আনতে মিয়ানমার সীমান্তে নৌকা নিয়ে গেছেন। গরু আনলে তা বিক্রি করে কুতুপালং এলাকার শরণার্থী ক্যাম্পে যাবেন। জেটির পাশেই রোহিঙ্গাদের গরু কেনা-বেচা হচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তারা দুজন। কথা বলার সময় তাদের দুজনেরই চোখে মুখে ছিল আতঙ্ক। নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আসায় এখনও তারা সহজ হতে পারেনি। আলম বলেন,‘মিলিটারিরা একসঙ্গে ২০০-৩০০ এলাকায় প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় মগ থাকে। মগরা ঘরে আগুন দেয়, লুটপাট করে। কাকে কাকে হত্যা করতে হবে তাও বলে দেয়। এরপর মিলিটারি তাদের ধরে নিয়ে গুলি করে, জবাই করে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের নাম খুইন্যাপাড়া। এই গ্রামের চেয়ারম্যান মো. ফয়সাল। তারা চার ভাই। বড় ভাইয়ের নাম মাস্টার রফিক, মেজো ভাই মাস্টার হারুন, সেজো ভাই চেয়ারম্যান ফয়সাল এবং ছোটভাই মো. হাফিজ। চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মো. হাফিজ সৌদি আরব থাকেন। চেয়ারম্যান অপর তিনভাইকে নিয়ে গ্রামেই ছিলেন। গত শুক্রবার তার বড় ভাই মাস্টার রফিক ও মেজো ভাই মাস্টার হারুনকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যায়। তাদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। এরপর হারুনকে জবাই করে হত্যা করে মিলিটারি। আর বড় ভাইয়ের কী হয়েছে তা আর জানা যায়নি। এলাকার যারা বড় বড় মানুষ তাদের মগরা ধরিয়ে দিচ্ছে। চেয়ারম্যান মংডুতে বিয়ে করছে বলে সে পালিয়ে মংডুতে গেছে। তাকে ধরতে পারেনি।’
রাজারবিল এলাকা থেকে মো. সিদ্দিক (৫০) নামে এক জেলে পরিবার নিয়ে মঙ্গলবার বিকালে টেকনাফে এসেছেন। তিনি বলেন,‘আমাদের পাশের গ্রামে রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) আগুন দেওয়া হয়। তখন আমাদের এলাকার মগরা আমাদের চেয়ারম্যান আমিনকে বলে, ৫০ লাখ টাকা দেও, তা না হলে তোমাদের বাড়িতেও আগুন দেওয়া হবে। চেয়ারম্যান সবার ঘর থেকে টাকা তুলে মগদের দেয়। এরপর দিন তারা আমাদের গ্রামে আগুন দেয়। এরপর আমাদের চেয়ারম্যান সবাইকে ডেকে বলে, এখানে আর থাকা যাবে না, তোমরা যে যেভাবে পারো গ্রাম ছেড়ে চলে যাও।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আমাদের চেয়ারম্যানও আসছে। তিনি তার পরিবার নিয়ে কুতুপালং এলাকায় চলে গেছেন।’