অ্যামেরিকা টু ঢাকা

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:১৮

কাজী তামান্না কেয়া

২০১৪ সালে প্রথম এসেছিলাম বোস্টন, অ্যামেরিকায়- উদ্দেশ্য হল কনফারেন্সে পেপার পাঠ করা। সেই উদ্দেশ্য সফল হলে বেরোলাম নিউইয়র্ক আর নায়াগ্রা ফলস বেড়াতে। চোখের পলকে দুই সপ্তাহ কেটে গেল। কনফারেন্স থেকে দেয়া প্লেনের টিকেট হাতে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম নাচতে নাচতে।

এর ঠিক এক বছর পর এমএস করতে আবার চলে এলাম অ্যামেরিকায়। এবারে এসেও বোস্টন শহরে পা রাখলাম। তবে এবারের অ্যামেরিকা আসা আগেরবার এর মত নয়- দীর্ঘ সময় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসা। তাই অনুভূতিগুলিও যেন কেমন  ভিন্ন। সত্যি কথা বলতে এ অনুভূতি কষ্টকর। লেখাপড়া শুরু হল পুরোদমে। মাস্টার্স চলাকালীন সময় এতটা চাপের মধ্য দিয়ে দিন কাটছিল যে বোস্টনের মত এত গুছানো শহরে থেকেও শান্তি পাচ্ছি না। চোখ মেলে কেন যেন এই শহরের সৌন্দর্য ঠিক উপভোগ করতে পারছি না। এরপরেও দেখতে দেখতে এক বছর শেষ হয়ে গেল। যেদিন গ্রাজুয়েশন সেরেমনি শেষ হল, দুই বন্ধুকে নিয়ে বোস্টন শহর ঘুরতে বের হলাম। এদের একজন ওয়ার্ল্ড ব্যংকের স্কলারশিপে পড়তে এসেছিল। এই স্কলারশিপের শর্ত হল পড়ালেখা শেষ হলে অবশ্যই দুই বছরের জন্যে নিজের দেশে ফেরত যেতে হবে। সাথের আরেক বন্ধু স্বল্প সময়ের জন্যে বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকা ঘুরতে এসেছে। ওরা দুজনেই তাই দেশে ফিরে যাবে এবং দুজন মিলে দেশে ফেরার টিকেট কাটা, ফ্লাইট কনফার্ম করা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছিল। 

ওদিকে আমি পড়েছি তীব্র মনঃকষ্টে- এ কষ্ট দেশে ফিরতে না পারার কষ্ট। এ এক ভয়ংকর যন্ত্রণা, ঠিক সহ্য করার মত নয়। এ যন্ত্রণা কাউকে দেখানো যায় না, বোঝানো যায় না, শুধু আমার নিজের ভেতর থেকে জেগে উঠে নিজেকেই কুড়ে কুড়ে খায়। হঠাৎ কি হল জানি না। সংকল্প করে বসলাম- যা হয় হবে, দেশে ঘুরতে যাব। কিছুদিন আগেই ক্রেডিট কার্ড হাতে পেয়েছি। এর মানে ব্যংক আমাকে বিনা জামানতেই টাকা ধার দিচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীদের হাতে ক্রেডিট কার্ড - বাংলাদেশে এ আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু দেশটার নাম যে অ্যামেরিকা। এখানে জীবনের আরেক নাম ক্রেডিট কার্ড।

আগপিছ না ভেবে ৭ দিনের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে দিলাম। প্লেনের টিকেট কনফার্ম করলাম, নিজের আসবাবপত্রগুলি বন্ধুদের বিলিবন্টন করে দিলাম আর বোস্টন শহর পেছনে ফেলে বাসে করে চলে এলাম নিউইয়র্ক। বোস্টন থেকে যে টিকেট কিনতে ১২০০ ডলার লাগবে, সেই টিকেট নিউইয়র্ক থেকে পাওয়া যায় ৭০০ ডলারে। ছাত্র অবস্থায় পয়সা বাঁচাতে তাই কেনেডি বিমান বন্দর থেকে দুবাইয়ের প্লেনে উঠলাম। তাছাড়া বোস্টন শহরে ফিরে আর কাজ নেই আমার। ছুটি কাটিয়ে কোথায় চাকুরিতে জয়েন করব তা আগেই ঠিক করা ছিল। সময়টা ছিল ২০১৬ সালের মে মাসের দিকে। আমি দেশে ফিরে এলাম আর শান্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

প্রায় আড়াই মাস ঢাকা থেকে ফিরে এলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্টার্ন হিসেবে চাকুরীতে জয়েন করলাম। মাস দুই যেতে না যেতেই ছোট বোনের এনগেজমেন্ট। এর ক'মাস বাদেই দেখতে দেখতে তার বিয়ের ডেট পাকা হয়ে গেল। আমি ঢাকা থেকে ফিরেছি কেবল ১০ মাস হয়েছে। দেশে যাবার তাই কোন পরিকল্পনাই নেই। হঠাৎ করেই দেশে ফেরার তীব্র যন্ত্রণা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। যেই কথা সেই কাজ। বসকে যেয়ে বললাম আমার ১০ দিনের ছুটি লাগবে- ঢাকা যেতে চাই। বস ছিল অতি অমায়িক এক ব্রিটিশ ভদ্র মহিলা। অ্যামেরিকায় সে থিতু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। দেশ ছেড়ে থাকার কষ্টটা এ জন্যেই বুঝি সে বুঝতে পেরেছিল। এবারেও ৭ দিনের মধ্যে প্লেনের টিকেট কেটে, বোনের বিয়ের কেনাকাটা করে প্লেনে চড়ে বসলাম। আহা, কি প্রশান্তি! নিজের মায়ের কাছে, বোনের কাছে, ভাইয়ের কাছে ফিরে আসার শান্তি।

প্রায় দেড় বছর হতে চলল ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। অপেক্ষা করছি আবার একদিন মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হবে। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াবে, আমি আগপিছ না ভেবে প্লেনের টিকেট কেটে বসব ক্রেডিট কার্ডের ধার করা টাকায়। জানি না, কত দিন অপেক্ষা করতে হবে সেই যন্ত্রণাময় অনুভূতির দেখা পেতে। যন্ত্রণার দেখা পাওয়ার শেষে মায়ের মুখ দেখা আর দেশের মাটি ছুঁতে পারা যে আনন্দ এনে দেয়, সেই আনন্দের অনুভূতি প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বোঝে বলে আমি বিশ্বাস করি না। 

জাগরণীয়ার ইমেইল থেকে