কমলগঞ্জে প্রকৃতির হাতছানি
প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:০৩
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা একটি ইতিহাস, পর্যটন, প্রকৃতি সমৃদ্ধময় এলাকা। এখানে প্রকৃতির অপরূপ লীলা নিকেতনে সব সময় হারিয়ে যেতে মন চায়। এখানে রয়েছে বিশেষ করে চা বাগান, লাউড়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান এর স্মৃতিস্তম্ভ। ঈদের ছুটি কিংবা যে কোন সময় প্রকৃতি নিবিড় পরশে ঘুরে আসতে পারেন ওইসব দর্শনীয় স্থান গুলো।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝে সবচেয়ে দর্শণীয়, নান্দনিক ও আকর্ষণীয় স্থান কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এক অপার লীলা ভূমি। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় জীব জন্তুর শেষ নিরাপদ আবাসস্থল। এ উদ্যানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে ঢাকা-সিলেট রেল পথ। এখানকার চিরচেনা সবুজ গাছ-গাছালির মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ না করলে কোন ভ্রমনের সার্থকতাই থাকে না।
১৯২৫ সালে বনায়ন করে সৃষ্ট বনরাজির ফল মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২.৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১২৫০ হেক্টর এলাকা এখন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছ। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান হিসেবে। যা দেশ বিদেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত। দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেশ বিদেশের দর্শনার্থীদের জন্য হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয় পর্যটন স্থানে। গভীর অরণ্যে সমৃদ্ধ এই উদ্যানের মোট এলাকার ৮৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে রয়েছে দীর্ঘ মেয়াদী বাগান, ১৭০ হেক্টর এলাকায় স্বল্প মেয়াদী বানিজ্যিক প্রজাতির বাগান, ২১ হেক্টর এলাকায় বাঁশ ও বেত, ১৩০ হেক্টর এলাকায় মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির আিধবাসীদের পান জুম। বিভিন্ন পর্যায়ের ও বিভিন্ন বয়সের গাছ-পালা এবং অন্যান্য স্থানীয় লতাপাতার বিপুল সমারোহ এই বনকে করেছে আকর্ষনীয়। আগর বাগান, বিরল প্রজাতির গাছ, বর্ণিল নানা প্রজাতির পাখির ডাক, ছড়া/ ঝরনা,বনফুল,অর্কিড,চশমাবানর,খাসিয়াদের পান চাষ, বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় দূর্লভ উল¬ুক এগুলো হল এই বনের বিশেষ আকর্ষন। এ বনের বিচিত্র্য পশু-পাখি ও পোকা মাকড়ের অদ্ভুত এক ঝিঝিমিঝি শব্দ, বানরের ভেংচি, ভাল¬ুকের গাছে গাছে ছুটাছুটির দৃশ্য পর্যটকদের মনে অনাবিল আনন্দের শিহরণ জাগিয়ে তুলে। রুপকথার কাহিনী সৃষ্টিকারী লাউয়াছড়া হল বিরল প্রজাতির রং বেরংগের পশু পাখির অভয়াশ্রম। পাখির মেলায় মুখরিত এই উদ্যানে ছুটে আসেন দেশ বিদেশের পাখি প্রেমিকরা। রক্ষিত এলাকায় ভ্রমণের সময় আপনি পদত্ত তথ্য/চেকলিষ্ট ব্যবহার করে পাখি সনাক্ত করণ ও গণনার রোমাঞ্চ উপভোগ করতে পারবেন। পাখি সনাক্ত করণের জন্য পাখির আকার (বিশেষতঃ লেজ) ঠোটের গঠন, চোখের রং, পালকের রং, যে পরিবেশে দেখা গেছে, ডাক ও উড়ার ধরণ বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতে হবে। বনের ভিতর সব সময় দেখা যায় চিরচেনা বানরের ভেংচি, ভাল¬ু¬কের গাছে গাছে ছুটাছুটির দৃশ্য। এখানে বয়েছে দক্ষিন এশিয়ার বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ক্লোরোফোর্ম। লাউয়াছড়া বনের চার পাশ ঘিরে আছে মৃত্তিঙ্গা, ভাড়াউড়া, ভূরভুরিয়া, ঘিলাছড়া, নূরজাহান, ফুলবাড়ি চা বাগান এবং বালিশিরা পাহাড়। এছাড়াও লাউয়াছড়া বনের উপর কোন না কোন ভাবে নির্ভর করে বেঁচে থাকা স্থানীয় খাসিয়া, চা বাগানবাসী, মান্দি, টিপরা ও দরিদ্র বাঙ্গালী। লাউয়াছড়া সর্বদা থাকে নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারনায় মুখরিত। লাউয়াছড়া ভ্রমন পিপাষু সৈাখিন মানুষ ও আসা সাহিত্যিকদের নিয়ে যায় অজানা স্বপ্নপুরীতে। নিসর্গ এই উদ্যানে ভ্রমনের জন্য ১টি ৩ ঘন্টার, ১টি ১ ঘন্টার ও ১টি আধাঘন্টার প্রাকৃতিক ট্রেইল বা পায়ে হাটার পথ চিহ্নিত করেছ। প্রতিটি ট্রেইলে রয়েছে বিশেষ বিশেষ আকর্ষণ ও ঘন বনে চলার শিহরণ। নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প নানাবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করেছ্ েইকো টুরিষ্ট গাইড। লাউয়াছড়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও অজানা গহীন বনের অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করেছে গাইডরা। উদ্যানে রয়েছে পর্যটকদের জন্য তথ্য কেন্দ্র। রয়েছে ইর্কো কটেজ ইন্সপেকশন বাংলো, গোলঘর, ফেন্সিবীজ, টয়লেট প্রভৃতি। পর্যটকদের সুবিধার জন্য পার্কের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে বিল বোর্ড ও নিদের্শনামূলক সাইনবোর্ড। এছাড়া আছে হাতির পিঠে চড়ে লাউয়াছড়া ভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগ। প্রকৃতি প্রেমীরা হাতির পিঠে ছওয়ার হয়ে লাউয়াছড়া উদ্যানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন। প্রকৃতির চিরন্তন অপরুপ সৌন্দর্য্যরে সমারোহের রাজত্বের জীবন্ত ছবি উপভোগকারীদের জন্য কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি অনন্য স্থান।
লাউয়াছড়ায় হাইকিং করার সময় আরামদায়ক কাপড় ও জুতা পরে আসবেন। প্রকৃতিকে অনুভব করার জন্য নীরবে ভ্রমন করুন। ক্যামেরা ও বাইনোকুলার, খাবার পানি সাথে রাখুন। আধিবাসী গ্রামে প্রবেশের আগে অনুমতি নিয়ে নিন। বনে প্রবেশের সময় ইকো-ট্যুর গাইড নিয়োগ করতে পারেন। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেববেন না, সাথে করে খালি প্যাকেট, বোতল প্রভৃতিতে ময়লা ফেরত আনুন। জোরে আওয়াজ করা যাবে না যাতে বনের পশু-পাখি ভয় পায়। পশু-পাখিকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। ভ্রমন শেষ করে সাথে করে স্মৃতি নিয়ে যান, বনের কোন লতা-পাতা ছিড়বেন না। স্থানীয় বা আধিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে সম্মান করুন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষনের জন্য সকলকে অবহিত করে, নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প কর্তৃক পরিচালিত বার্ষিক পাখি গণনাতে অংশগ্রহণ এবং নিজে প্রবেশ টিকেট ক্রয় করে ও অন্যান্যদের টিকেট ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করে আপনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারেন।
ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় লাউয়াছড়ার অবস্থান। প্রকৃতিপ্রেমী যে কোন কেউ লাউয়াছড়া দর্শনের ইচ্ছা পোষণ করলে ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেন অথবা বাসযোগে শ্রীমঙ্গল নেমে খুব সহজেই আসতে পারেন কমলগঞ্জের লাউয়াছড়ায়। সময় লাগবে আনুমানিক ৪ ঘন্টা। এই উদ্যানের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি মিশতে পারেন পাশাপাশি অবস্থানরত মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির জীবনধারার সাথে। সারা বছরই আপনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘুরার জন্য আসতে পারেন। পরিপূর্ণ ভাবে লাউয়াছড়া দর্শনের জন্য দুইদিন সময় অবশ্যই প্রয়োজন। রাত্রে থাকার জন্য কমলগঞ্জের অবস্থিত হীড বাংলাদেশের বাংলো। অথবা শ্রীমঙ্গল শহরে হোটেলে থাকতে পারেন। অজানাকে জানার জন্য, নিরব প্রকৃতিকে কাছ থেকে জানার জন্য এবং মনকে আনন্দময় অনাবিল প্রশান্তির ছোঁয়া লাগাতে একবার ঘুরে আসুন লাউয়াছড়া থেকে।
মাধবপুর লেক
চারিদিকে চা বাগান বেষ্টিত প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমির মধ্যে জাতীয় ফুল শাপলায় আচ্ছন্ন সৌন্দর্যের দৃষ্টি নন্দন পর্যটকদের আকর্ষণীয় মাধবপুর ‘লেক’। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের এই লেকটি পর্যটকদের সেবাদানের কথা ভেবে যোগ হয়েছে ঝুলন্ত যান, ভাসমান রেস্তোরাঁসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন। দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকলেও বর্তমানে মাধবপুর লেকটি এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণী।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মাধবপুর চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে অবস্থিত এই লেক। চা বাগানের শ্রমিকরা এটিকে 'ড্যাম' বলে অভিহিত করেন। সময়ের পরিক্রমায় এটি বৃহৎ ও আকর্ষণীয় ড্যামে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলার মাঝে প্রায় ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে পানির ড্যাম বা লেকের আয়তন ৫০ একর। পাহাড়ি টিলা স্পর্শ করে এঁকেবেঁকে যাওয়া ড্যামের চারপাশে উঁচু পাহাড়ি টিলা, চা বাগানের সবুজ বৃক্ষরাজি, দুর্লভ নীলপদ্ম বা বেগুনি-শাপলা, রঙবেরঙের জলজ ফুল শোভা বাড়িয়েছে। ড্যামে অসংখ্য নীলপদ্মের সমারোহের জন্য 'লেক অব দ্য লোটাস' বা পদ্মফুলের লেক বলে অভিহিত করা হয়। শীতে অতিথি পাখির কোলাহল আর বছরজুড়ে সরালি, পানকৌড়ি, জলপিপি, বালিহাঁসসহ নানা জাতের জলজ পাখি লেকে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। এখানকার ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা-শালুকের উপস্থিতি হৃদয়ে বাড়তি আনন্দের মাত্রা জানান দেয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই ড্যাম্পে ফি বছর শীত মৌসুমে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ও শিক্ষার্থীসহ ভ্রমনণপিপাসুদের ঢল নামতে শুরু করে। লেকের মাঝে ৩-৪ মণ ওজনের বড় বড় কচ্ছপ আর মাছ দেখলে বাড়তি আনন্দের মাত্রা যুক্ত হয়। সুদীর্ঘকাল ধরে এ লেকের নয়নাভিরাম অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে অগণিত মানুষ। লেকে প্রবেশপথটি শুধু পর্যটকদের জন্য পাকা করণ ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। লেকটিকে পর্যটকদের হেঁটে দেখার সুবিধার্থে লেকের চারপাশে টিলার ওপর উঠতে সিঁড়ি করে তার ওপর 'ওয়াকওয়ে' নির্মাণ করা হয়েছে। একেবারে লেক এলাকায় ভারী যানবাহন প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে হালকা যানবাহন প্রবেশকালে টোল আদায় করা হয়। গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, গেট ও পর্যটকদের বসার জন্য ছাউনি রয়েছে। শীতের সন্ধ্যায় এ লেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। লেকের সৌন্দর্যের প্রতীক কেউ বলে নীলপদ্ম আবার কেউ বলে বেগুনিপদ্ম।
প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা চা বাগানের মধ্যে এই লেকটি দেখার জন্য দেশি বিদেশী পর্যটকদের ভীড় সব সময় থাকে। লেকের পারে পর্যটকরা হাতে বাদাম, ঝালমুড়ি অথবা খাওয়ার অন্য দ্রব্য নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা, ভালবাসার গভীরতা প্রকাশ করতে লেকটি দারুনভাবে সহায়তা করে। লেকটি আসা যায়, দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে মৌলভীবাজার জেলা শহরে এসে মুন্সীবাজার হয়ে কমলগঞ্জ সদরের ভানুগাছ বাজার থেকে মাত্র ১০ কিঃমিঃ রাস্তা হয়ে আসা যায়। অথবা শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ হয়ে আসা যায়। পর্যটকরা সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখতে পারেন। লেক এর পাশপাশি চা বাগানের বিশাল পাহাড় রয়েছে। এগুলো দেখে সময় পার করে ইচ্ছে মতো গন্তব্যে ফিরে যেত পারেন। এখানে যাওয়ার জন্য কোন সমস্যা নেই। যে কোন ধরণের যানবাহন পাওয়া যায়। তাই একটু সময় পেয়ে ঘুরে আসতে পারেন মাধবপুর “লেক”। হাতছানি দিয়ে সকলকে কাছে ডাকছে।
হামহাম জলপ্রপাত
প্রকৃতি এত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে পাহাড়ী অধিবাসীরা পানি পতনের স্রোতধ্বনীকে হামহাম বলতো তাই এটি হামহাম নামে পরিচিত হয়ে গেল। অবিরত পাহাড়ী ঝরনা থেকে জল পড়েছে। শীতল এই ঝর্ণার কাছে গেলে বুঝা যাবে গরমও নয় ঠান্ডাও নয় যেন সব সময় শীতল আরামদায়ক। সেই অরণ্যের ভিতরটি নাম হচ্ছে হামহাম জলপ্রপাত। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কুরমা গহীন অরন্যে লুকিয়ে থাকা রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত অবস্থিত।
গহীন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় স্রষ্টার অপূব সৃষ্টি এই জলপ্রপাত ভ্রমন প্রিয় পর্যটকদের হাতছানী দিয়ে কাছে ডাকছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে এই জলপ্রপাতটি লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে হামহাম জলপ্রপাতটি পরিণত হয়ে উঠতে পারে মৌলভীবাজারের বড়লেখার আরেক মাধবকুন্ডে।
মৌলভীবাজর জেলা হচ্ছে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা। এখানে রয়েছে পর্যটকদের কাছে টানার সব কিছু। কিন্তু এর চেয়ে কাছে টানার আকষনীয় স্থান রয়েছে দুর্গম পাহাড়ের ভিতরে। নিজ চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস হবে না। সেই নয়নাভিরাম রোমাঞ্চিত জলপ্রপাত কুরমা হামহাম জলপ্রপাত। ১৩০ ফুট উচচতার এই জলপ্রপাতটিতে কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি রেঞ্জের ৭ হাজার ৯৭০ একর আয়তনের কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিমদিকে চাম্পারায় চা বাগান। পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৮ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। সেখানে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই।
কমলগঞ্জ-কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫কিঃ পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জীপ,মাইক্রোবাস যোগে যেতে পারলেও বাকী ১০ কিঃ মিঃ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কুরমা চেকপোষ্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত মাটির রাস্তা। যেতে যেতে আপনি চারিদিকে দেখতে পাবেন সবুজ চা বাগানের দৃশ্য। চায়ের কন্যারা মনের সুখে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলছেন। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল¬¬ী বন বিভাগের কুরমা বিটের অরণ্যঘেরা দুর্ঘম পাহাড়ী এলাকা তৈলংবাড়ি। অবশ্য সিএনজি যোগে তৈলংবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছা যাবে। ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা যেভাবেই যেতে চান না কেন গহীন অরন্যে প্রবেশের পূর্বে তৈলংবাড়ি কিংবা কলাবন বস্তির আদিবাসীদের সাহায্য নিয়ে প্রায় ৮ কিমি. দুর্ঘম পাহাড়ের ভিতর হামহাম জলপ্রপাতে যেতে হবে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কঠিন এবং কষ্টের। মাঝেমধ্যে সিমেন্টের ঢালাই করার মতো দেখতে বড় বড় পাথরের খণ্ড খুবই পিছলে, ডানে-বামে তাকালেই ভয় লাগবে। তাই ট্রেকিং করার সময় সবাইকে একটি করে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে পাহাড়ী এই পথে খুবই সাবধানে হাঁটতে হবে। কলাবন পাড়া থেকে হাঁটার সময় কলাগাছগুলো দেখলে মনে হবে কে যেন সুন্দর, সুশৃংখল, সারিবদ্ধভাবে লাগিয়ে রেখেছে। জারুল, চিকরাশি কদমের সারিবদ্ধ চারাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে হাজারো প্রজাপতি ডানা মিলিয়ে উড়ে যাচ্ছে বহুদূরে। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অগুনিত চশমা বানরের। চারদিকে গাছগাছালি, ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর আর ডলু, মুলি, মিরতিঙ্গা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ বাগানের রাজত্ব আপনাকে দেবে বাড়তি আনন্দ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে শোনা যাবে বিপন্ন বনমানুষ, উল্লুক, গিবনসের ডাক।
কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দু’চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে নয়নাভিরাম পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাবেন হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি। দূর থেকে শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। কাছে গিয়ে দেখতে পাবেন প্রায় ১৩০ ফুট ওপর হতে হামহাম শব্দে জল পড়ার সেই অপূর্ব দৃশ্য। আপনার মন ক্ষনিকের জন্য হয়ে উঠবে প্রাণঞ্চল্য। সেখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে নিতে হবে ফেরার প্রস্তুুতি। ঢালু ও পিচ্ছিল পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে ওঠা কষ্ট হলেও সহজ, কিন্তু নিচে নেমে আসা খুবই বিপদজ্জনক ও কঠিন। তাই ভ্রমন কারীদের সবাইকে কাছাকাছি থেকে সতর্কতার সহিত ট্রেকিং শুরু করতে হবে। প্রায় সাড়ে চারঘন্টা পর ফিরা যাবে কলাবনে। ভ্রমন পিপাসু মানুষ কমলগঞ্জ অথবা শ্রীমঙ্গল শহর হতে যানবাহন ভাড়া করে ভোর ছয়টার মধ্যেই হামহামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, মনোরম প্রকৃতির নির্জন স্থান দেখতে চলে আসতে পারেন নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাতে। স্থানীয়রা বলেন, সরকার এই জলপ্রপাতটি পর্যটকদের আগমনের জন্য সবধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে মৌলভীবাজার জেলা তথা বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অন্যতম একটি পর্যটন এলাকা হিসাবে রূপান্তরিত হবে।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করেছে। হামিদুর রহমানের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তৎকালীন শ্রীমঙ্গলের ১৭ রাইফেল ব্যাটালিয়ন কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি সংলগ্নস্থানে শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান ‘বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণী’ নির্মাণ করে। এখানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন এ স্মৃতিসৌধ দেখতে আসছেন।