বাল্যবিবাহের আসর থেকে ব্রোঞ্জ পদকের মঞ্চে
প্রকাশ | ০৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৫১ | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৫৫
বাল্য বিবাহের আসর থেকে উঠে এসে তিরন্দাজ সংসদের হয়ে মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছে চুয়াডাঙ্গার কিশোরী ইতি।
০৪ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) শেখ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে তীর নবম জাতীয় আর্চারিতে প্রথম পদক জিতেছে ইতি। চুয়াডাঙ্গার হোটেলের কর্মচারী ইবাদত আলীর মেয়ে ইতি।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আর্চারির প্রাথমিক বাছাইয়ে হয়েছিল প্রথম। চুয়াডাঙ্গার ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী এই প্রথম অংশ নিয়েছে জাতীয় আসরে। প্রথমবার বড় প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েই ব্রোঞ্জ জিতে ভীষণ খুশি ইতি।
বাবা ইবাদত আলী তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। মেয়েদের স্কুলের খরচ জোগাতে পারেন না বেশির ভাগ সময়। তাই মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। বাল্য বিবাহের আসর থেকে উঠে এসে বায়না ধরলো সে বিয়ে করবে না। সে পড়ালেখা করতে চায়। পড়ালেখা এবং তির-ধনুকের খেলায় এতটাই মজে গিয়েছিল যে বাবা-মায়ের বকুনিকেও পরোয়া করেনি।
কিন্তু সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, ইবাদত আলী তা কাল নিজের চোখেই দেখলেন। মেয়ের খেলা দেখবেন বলে সে চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছেন টঙ্গীতে। কাল শেখ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্যালারিতে। মেয়ে পদক জেতায় ইবাদত আলীর মুখে গর্বের হাসি।
মেয়েকে কেন এত কম বয়সে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? প্রশ্নটা করতেই লাজুক হেসে বললেন, ‘আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। একে তো গরিব, তার ওপর কীভাবে সংসার চালাব, ভেবে পেতাম না। মেয়েদের পেছনে অনেক খরচ হয়। তাই ভেবেছিলাম বিয়ে দিয়ে দিই। পরে ভুল বুঝতে পেরেছি। আর ও পথে পা বাড়াইনি।’
অনুশীলনে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলের ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছে ইতি। এক বছর ধরে আছে আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের ট্রেনিং সেন্টারের আবাসিক ক্যাম্পে। আর্চারি খেলার কারণে ক্লাব ও ফেডারেশন কিছু আর্থিক সাহায্য করেছে। টাকাগুলো এরই মধ্যে ইতি তুলে দিয়েছে বাবার হাতে।
ইতির গলায় পদক দেখে খুশিতে আটখানা ইবাদত আলী বলছিলেন, ‘আমার এলাকার ঘরে ঘরে এখন একটাই কথা, ইবাদতের মেয়ে কোথায় গেছে তোমরা দেখো। একদিন কাজ না করলে সংসার চলে না। মেয়ে মেডেল জেতায় কী যে ভালো লাগছে বলে বোঝানো যাবে না।’
পদক জয়ের পর ইতি বললেন, ‘বাবা বলতেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, কেন খেলবি? মা-বাবা কেউই আমাকে খেলতে দিত না। পড়াশোনাও করতে দিত না। ঢাকায় যখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে আসার সুযোগ পেলাম, তখন কেউই পাঠাবে না। আমি রাগ করে দুই-তিন দিন আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলিনি। পরে আব্বু রাজি হয়ে আমাকে ঢাকায় খেলতে পাঠান।’
এখানেই থেমে থাকতে চায় না ইতি। স্বপ্নটা দূরের বাতিঘরে, ‘আগে বাড়িতে দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারতাম না। কিন্তু এখানে উন্নত পরিবেশে থেকে যেসব খাবার খাচ্ছি, সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, সেটা কাজে লাগাতে চাই। আগামী এসএ গেমসে সোনা জিততে চাই আমি।’
বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে এরই মধ্যে একটা যুদ্ধে জিতে গেছে ইতি। এবার মাঠের লড়াইয়ে জিতে উঠতে চায় সোনার পদকের মঞ্চে।