চাঁদে প্রথম নারী হিসেবে যাচ্ছেন ক্রিশ্চিনা; কী তার পরিচয়?
প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:২৯ | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:৫৭
বহুদিন পর চাঁদে আবারও মানুষের পা পড়বে। তবে এবার ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে চলেছে। এই প্রথম চাঁদে পা পড়বে কোনো নারীর। শুধু তাই নয়, চন্দ্রাভিযানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো প্রথম নারী হিসেবে মিশনের বিশেষজ্ঞের দায়িত্বও পালন করবেন তিনি, তার নাম ক্রিশ্চিনা হ্যামক কোচ। নাসার আর্টেমিস প্রকল্পের অংশ হিসেবে আর্টেমিস ২ চন্দ্রাভিযানের মহাকাশচারী ক্রিশ্চিনা হ্যামক এর সফরসঙ্গী হচ্ছেন আরও তিনজন। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার পরিকল্পিত এই অভিযানের অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছেন- জেরেমি হ্যানসেন, ভিক্টর গ্লোভার ও রিড ওয়াইসম্যান। তারা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাগারে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন।
এই চার নভোচারীকে বাছাই করেন নাসার ফ্লাইট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নরম্যান ডি নাইট। সোমবারের আয়োজনে নাসার পরিচালক বিল নেলসনের সঙ্গে নতুন দল ঘোষণাতেও তিনি ছিলেন।
নাসা বলছে, তারা এমন এক প্রকল্পের নভোচারী হতে যাচ্ছেন, যাদের শেষ পর্যন্ত চাঁদে অবতরণের সম্ভাবনা আছে। আর একে পরবর্তীতে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহারের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট। তবে মিশনের সদস্যদের কেউ কেউ এরইমধ্যে বিভিন্ন যুগান্তকারী মহাকাশ মিশন পরিচালনা করেছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রিশ্চিনা। চাঁদে পা দিতে যাওয়া এই নারী সব মিলিয়ে মহাকাশে কাটিয়েছেন ১১ মাস। কোনো নারীর মহাকাশে দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সময় কাটানোর ও প্রথম নারী হিসেবে স্পেসওয়াকে অংশ নেওয়ার রেকর্ডও ক্রিশ্চিনার দখলে।
কে এই ক্রিশ্চিনা হ্যামক কোচ?
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (ISS) ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন ক্রিশ্চিনা হ্যামক কোচ। তিনি ২০১৩ সালে নাসা’র মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। বিশেষত, তিনি নাসার প্রথম উইমেন স্পেসওয়াকে অংশগ্রহণ করেন, এবং মহাকাশে ৩২৮ দিন যাপনের মাধ্যমে দীর্ঘতম একক স্পেসফ্লাইটের রেকর্ড গড়েন।
প্রাথমিক জীবন
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের উত্তর ক্যারোলিনার জ্যাকসনভিলে শৈশব কাটে ক্রিশ্চিনার। তখন থেকেই কঠোর পরিশ্রমী এবং রোমাঞ্চকর কাজগুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল তার। কোচ ব্যাকপ্যাকিং, রক ক্লাইম্বিং, প্যাডলিং, সার্ফিং, দৌড়, যোগব্যায়াম, সম্প্রদায় পরিষেবা, ফটোগ্রাফি এবং ভ্রমণ নিয়ে থাকতো তার ব্যস্ততা। মিশিগানে পরিবারের সাথে ক্রিশ্চিনা বেড়ে উঠলেও মহাকাশচারী কর্পসে যোগদান করার পর লিভিংস্টনে বসবাস শুরু করেন এই মহাকাশচারী।
শিক্ষা
ক্রিশ্চিনা ডারহামে অবস্থিত নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অফ সায়েন্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স এবং নর্থ ক্যারোলিনার জ্যাকসনভিলের হোয়াইট ওক হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীতে উত্তর ক্যারোলিনার রালেতে ‘নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি’-তে তিনি পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন।
অভিজ্ঞতা
মহাকাশচারী হওয়ার পূর্বে ক্রিশ্চিনার কর্মজীবন ‘মহাকাশ বিজ্ঞান যন্ত্রের উন্নয়ন’ এবং ‘দূরবর্তী বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র প্রকৌশল’ উভয় ক্ষেত্রেই বিস্তৃত ছিল। শুরুর দিকে তিনি নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে (GSFC) একজন বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যেখানে তিনি নাসার বেশ কয়েকটি মহাকাশ বিজ্ঞান মিশনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রগুলিতে অবদান রেখেছিলেন। এরপর ক্রিশ্চিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টার্কটিক প্রোগ্রামে একজন গবেষণা সহযোগী হন। এই ভূমিকায় থাকাকালীন তিনি উদ্ধারকারী দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছিলেন। ক্রিশ্চিনা জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ফিজিক্স ল্যাবরেটরির স্পেস ডিপার্টমেন্টে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মহাকাশ বিজ্ঞানের যন্ত্রের বিকাশে ফিরে আসেন।
এক পর্যায়ে ক্রিশ্চিনা অ্যান্টার্কটিকার পামার স্টেশনে এবং গ্রিনল্যান্ডের সামিট স্টেশনে শীত মৌসুমে ভ্রমণের সাথে দূরবর্তী বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের কাজে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এনওএএ) যোগদান করেন। তিনি দূরবর্তী বৈজ্ঞানিক ঘাঁটিতে কাজ চালিয়ে যান, আলাস্কার উটকিয়াগভিক-এ ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং তারপরে আমেরিকান সামোয়া অবজারভেটরির স্টেশন চিফ হিসেবে কাজ করেন। তার সমগ্র কর্মজীবনে প্রযুক্তিগত নির্দেশনা, স্বেচ্ছাসেবী তৈরি এবং শিক্ষাগত প্রচারের সাথে জড়িত ছিলেন এই মহাকাশচারী।
নাসাতে ক্রিশ্চিনার অভিজ্ঞতা
২০০১ সালে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার একাডেমি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন ক্রিশ্চিনা। তার কর্মজীবনের শুরুতে GSFC-তে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করেছিলেন। পরে ২০১৩ সালে নাসার ২১ তম মহাকাশচারী শ্রেণীর আট সদস্যের একজন হিসাবে নির্বাচিত হন, এবং ২০১৫ সালে মহাকাশচারী প্রার্থী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। পরে ২০১৮ সালে নাসার ISS স্যাটেলাইটের একটি দীর্ঘ মিশনে ক্রিশ্চিনাকে প্রথম মহাকাশ ফ্লাইটে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নাসার আর্টেমিস মিশনের স্পেশালিস্ট হিসেবে নিযুক্ত করা হয় ক্রিশ্চিনাকে।
এ ছাড়াও ISS এ একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে থাকাকালীন ক্রিশ্চিনা এবং তার ক্রু রা জীববিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, মানব গবেষণা এবং প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তার মিশনের কাজ হিসেবে আলফা ম্যাগনেটিক স্পেকট্রোমিটার ডেভেলপমেন্ট (যা অন্ধকার পদার্থ অধ্যয়ন করে) উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ক্রিশ্চিনা আরও ছয়টি স্পেসওয়াক পরিচালনা করেছেন। প্রথম তিনটি ছিল মহিলা স্পেসওয়াক যেখানে তিনি মোট ৪২ ঘন্টা ১৫ মিনিট যাপন করেন।
এ সকল স্পেস ফ্লাইটের পর ক্রিশ্চিনা মহাকাশচারী অফিসে নিয়োগকৃত ক্রুদের শাখা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি বর্তমানে টেকনিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের জন্য নাসার জনসন স্পেস সেন্টারের পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা
ক্রিশ্চিনা হ্যামক কোচ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে ‘নিল আর্মস্ট্রং অ্যাওয়ার্ড অফ অ্যাক্সিলেন্স’, ‘অ্যাস্ট্রোনট স্কলারশিপ ফাউন্ডেশন ২০২০’; ‘অ্যাস্ট্রোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘ন্যাশনাল স্পেস ক্লাব ও ফাউন্ডেশন ২০২০’; ‘গ্লোবাল অ্যাথেনা লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ‘অ্যাথেনা ইন্টারন্যাশনাল ২০২০’। ‘নাসা গ্রুপ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ‘নাসা জুনো মিশন জুপিটার এনার্জিটিক পার্টিকেল ডিটেক্টর ইনস্ট্রুমেন্ট ২০১২’; ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি’, ‘ইনভেনশন অফ দ্য ইয়ার নোমিনি ২০০৯’; ‘উইন্টার-ওভার ডিস্টিনশন সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস অ্যান্টার্কটিক সার্ভিস মেডেল ২০০৫’; ‘নাসা গ্রুপ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ‘নাসা সুজাকু মিশন এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার ইন্সট্রুমেন্ট ২০০৫’ উল্লেখযোগ্য।
জাগরণীয়া.কম/ডিআর.