সরাসারি দেখুন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপন
প্রকাশ | ১০ মে ২০১৮, ১৯:৪৩ | আপডেট: ১১ মে ২০১৮, ০২:৫৭
ঘনিয়ে আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ডানা মেলবে আকাশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যোগ হতে যাচ্ছে সাফল্যের আরেকটি পালক।
যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ দেশটির ফ্লোরিডার কেপ কেনাভেরাল লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ব্যবহার হবে একটি ফ্যালকন-৯ ব্লক ফাইভ রকেট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের পিছনে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অজানা তথ্য
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের ‘থ্যালাস অ্যালেনিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। অন্যগুলো ভাড়া দেওয়া হবে। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে।
বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করলেও বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়।
এর আগে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বাংলাদেশকে নিরক্ষরেখার ১০২ ডিগ্রি স্লট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ তাতে বাধা দেয়। দেশগুলোর আপত্তির মুখে বাংলাদেশ বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকে। বিকল্প হিসেবে ৬৯ ডিগ্রিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু বিকল্প প্রস্তাবেও আপত্তি তোলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন।
সর্বশেষ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রিতে (পূর্ব) স্লট বরাদ্দ পাওয়া যায়। কিন্তু এই স্লটটিও খালি ছিল না। স্লটটি ছিল ইন্টারস্পুটনিকের। কিন্তু অর্থের সংস্থান না হওয়ায় রাশিয়ার মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুটনিকের নিজস্ব দুটি স্লটের বিপরীতে (৮৪ ও ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) দুই মাসের একটি শর্তহীন চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্প শুরুর আগেই বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শক নিয়োগ এবং প্রকল্প গবেষণায় সরকারের ব্যয় হয় ৮৬ কোটি টাকা। এই টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করেছে।
উল্লেখ্য, ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রির অরবিটাল স্লটে (নিরক্ষরেখায়) উড়বে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য অরবিটাল স্লট বা নিরক্ষরেখা (১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এ স্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সে সময় উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি। ইন্টারস্পুটনিকের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি হলেও এ চুক্তি তিন ধাপে ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই প্রকল্পে সরকারের যে টাকা খরচ হবে, তা স্যাটেলাইট ভাড়া দিয়ে আট বছরে তুলে এনে এই প্রকল্পকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে এই উৎক্ষেপণ উপলক্ষে বাংলাদেশিদের পদচারণায় উৎসবমুখর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি, কোকোয়া বিচ ও অরল্যান্ডো এলাকা।
শুধু ফ্লোরিডা নয়, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়াসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে শত শত প্রবাসী বাংলাদেশি ফ্লোরিডা যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স-এর মিডিয়া বিভাগ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১২ মিনিটে মহাকাশে যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আনুষ্ঠানিক সময় ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) প্রস্তুত। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ফ্লোরিডা ছুটে গেছেন ৩০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি ও বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী ড. সিদ্দিকুর রহমান, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জয়নাল চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সেন্টুসহ ফ্লোরিডার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
ড. সিদ্দিকুর রহমান জানান, উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান উৎসবমুখর করতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে ফ্লোরিডা যেতে শুরু করেছেন। শুধু দলের নেতা-কর্মীরাই নন, এই অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণে ফ্লোরিডাগামী হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষজন। ১০ মে’র অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখতে পুরো দিনটি ঘিরে ফ্লোরিডা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল থেকে কেনেডি স্পেস সেন্টারের আশপাশে নেতাকর্মীরা আনন্দ র্যালি বের করবে। সন্ধ্যার পর থেকে ফ্লোরিডার আকাশজুড়ে আতশবাজির ঝলকানি দেখা যাবে।
তিনি বলেন, ৯ মে থেকে কেনেডি স্পেস সেন্টারের পার্শ্ববর্তী কোকোয়া বিচের অধিকাংশ হোটেলে রুম খালি নেই। অভ্যন্তরীণ এয়ার লাইন্সগুলোতেও আসন মিলছে না।
এদিকে উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানের পরের দিন কোকোয়া বিচ হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস। সজীব ওয়াজেদ জয় ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে গেলে নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এছাড়া এই স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেমন নির্ভরতা কমবে অন্য দেশের ওপর, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।