অনলাইনে ৭০ শতাংশ নারীই হয়রানির শিকার
প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০১৭, ২১:৩৬ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৭, ২১:৪৩
দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো ধরনের হয়রানির শিকার। বিশ্বজুড়ে অনলাইনে এমন ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের 'অনলাইন হ্যারাসমেন্ট রিপোর্ট ২০১৭'-তে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক জরিপ জানাচ্ছে, শুধু অনলাইন মাধ্যম নয়, সিলিকন ভ্যালির মতো তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রাণকেন্দ্রেও বিনিয়োগকারী এবং কর্মরত নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
এ দুটি প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী অনলাইন মোগলদের চিন্তিত করে তুলেছে। ফেসবুক এবং গুগলের নীতিনির্ধারকরা ব্যবহারকারীর পরিচয়, তথ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। ফেসবুকের এশিয়া অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা জানান, আগামী বছরের শুরুতেই সাইটটিতে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নতুন কিছু ফিচার দেখা যেতে পারে। এসব নিয়ে ফেসবুক সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিরাপত্তা শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, গত ছয় মাসে অনলাইন ব্যবহারকারী অন্তত ১০০ নারী তাদের কাছে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। তবে নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণের শিকার নারীদের অধিকাংশই নানা কারণে অভিযোগ করেন না। তাদের তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা এমনকি অশ্লীল আক্রমণেরও শিকার।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের রিপোর্টে যা আছে : এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন ব্যবহারকারীর ৬২ শতাংশই হয়রানি ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার। এ ছাড়া ৪১ শতাংশ হামলার শিকার হচ্ছেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে। তারা রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিষয়ে মত প্রকাশের জন্য উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাদের উত্তেজক ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সরাসরি হত্যার হুমকিও পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা হয়রানি বা হুমকি দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশেরই অনলাইনে পরিচয় সুনির্দিষ্ট নয়। অথবা তারা ভিন্ন পরিচয়ে অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করছে। হয়রানিকারীদের মধ্যে ভুয়া কিংবা পরিচয় গোপন রাখা ব্যবহারকারী ৭২ শতাংশ। মজার তথ্য হচ্ছে, অনলাইনে পরিচয় গোপনকারীদের হয়রানিমূলক পোস্ট বা মন্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করছেন প্রকৃত পরিচয়ধারীদের ৬৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত অসচেতন ব্যবহারের কারণে হ্যাকিং কিংবা নিজেদের অজান্তেই তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতারণামূলক পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছেন আট শতাংশ।
প্রতিবেদনে এ ধরনের হয়রানি বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট চূড়ান্ত করার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে সুনির্দিষ্ট পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়। এমন কোনো তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় সবার সামনে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানিমূলক আচরণ থেকে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি পর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে যারা অনলাইন মাধ্যম পরিচালনা করছেন. ব্যবহারকারীদের সুরক্ষার একটি দায়িত্ব প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরই নেওয়া উচিত।
সিলিকন ভ্যালিতেও যৌন হয়রানি : এদিকে সিলিকন ভ্যালিতে যৌন হয়রানি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট প্রযুক্তি দুনিয়ায় রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত প্রায় ৫০০ নারীর ওপর চালানো জরিপের তথ্য এবং কয়েকজন নারী বিনিয়োগকারী ও কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার তুলে ধরা বলা হয়, সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকরা নারী কর্মীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌন আচরণের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন কিংবা যৌন আবেদন সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করছেন, যা হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। নারী কর্মীদের প্রতিভা ও উদ্ভাবনী চিন্তার মূল্যায়ন এখানে যথাযথভাবে হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে একাধিক নারী বিনিয়োগকারীদের সাক্ষাৎকার তুলে ধরে বলা হয় নারী বিনিয়োগকারীরাও নারী হওয়ার কারণে কম মূল্যায়িত হচ্ছেন। নারী বিনিয়োগকারীরা নতুন কোনো উদ্ভাবন প্রকাশ করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তির্যক আক্রমণের শিকারও হচ্ছেন; অথচ পুরুষ বিনিয়োগকারীরা কোনো উদ্ভাবন করলে প্রশংসিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানেও এখানে নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন। এখানে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রায় ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যেখানে নারী বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশে অনলাইনে নিরাপদ নয় নারী : ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিরাপত্তা শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকে হয়রানির শিকার হওয়া নারীর অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এ ধরনের অভিযোগ পড়ার হার বেশি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ১০০ নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি ও অপদস্থ হওয়ার অভিযোগ করেছেন। তিনি এ-ও জানান, প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট থেকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছে।
নারী অধিকার বিষয়ক লেখক শাশ্বতী বিপ্লব জানান, দেশে ফেসবুকে নারীদের প্রতি যারা আক্রমণ করছেন, তাদের অধিকাংশের পরিচয় সুনির্দিষ্ট। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল বলেও পরিচিত। কিন্তু নারীর প্রতি অশ্লীল আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা অবলীলায় নিজেদের উগ্র মৌলবাদীদের সমার্থক করে ফেলছেন। তিনি জানান, এখন অনলাইনে সবচেয়ে বেশি নোংরা ভাষায় নারীদের আক্রমণ করা হচ্ছে 'নয়ন চ্যাটার্জ্জি' নামের একটি আইডি থেকে। এই ব্যবহারকারীর প্রোফাইলে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। অথচ এই ভুয়া আইডি থেকে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কোনো পোস্ট দেওয়ার পর তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত পরিচয়ধারী ও পরিচিত আইডি থেকে। তারা লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিয়ে নারীবিদ্বেষী নোংরা পোস্টকে মহিম্বান্বিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও ফেসবুকে ক্রমাগত অশ্লীল আক্রমণের শিকার বলে জানান তিনি। তার মতে, শুধু আইনি কাঠামোর মাধ্যমে এর প্রতিকার করা সম্ভব নয়। নারীর প্রতি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে এর প্রকৃত প্রতিকার হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, অনলাইনে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের হয়রানি কমবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যপারে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন টিনএজ নারীরা। এ বয়সের একটি আবেগ থাকে। এ কারণে তারা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিও তুলছেন। বন্ধুরা সেসব ছবি ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে তাকে হয়রানি বা ব্ল্যাকমেইল করছে। এ জন্য বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রেও নারীদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হয়রানির শিকার নারীদের আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি বলেও মত দেন তিনি।
অনলাইনে নারীর প্রতি নোংরা আক্রমণকারী নয়ন চ্যাটার্জ্জি নামের আইডি সম্পর্কে পুলিশ সূত্র জানায়, এ আইডি এর আগে চারবার বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে সে 'নয়ন চ্যাটার্জ্জি-৫' নামে আইডি খুলে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাচ্ছে। তার ভাষার ব্যবহার ও প্রকাশের ধরণ থেকে মনে করা হচ্ছে, সে কোনো উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য হতে পারে। এই আইডির পেছনে থাকা ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও সূত্র জানায়।
সূত্র: সমকাল