টাকার আকাশে ওড়া সাবিনাদের সস্তার জীবন
প্রকাশ | ০৩ জুলাই ২০১৭, ১৬:৩৫
১৩ বছরের মেয়েটি। সার্ভেন্ট রুমের মেঝেতে পড়ে থাকা সস্তার জীবন। এক থাল ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের জন্য মায়ের আঁচল ছেড়ে আসা সস্তার জীবন এভাবে রুটি বেলুনীর আঘাতে কালশিটে পড়ে থকথকে ঘা হয়ে বেঁচে থাকে। একটি ডিম ভাজা নষ্ট করার অপরাধে গৃহকর্ত্রি আয়েশা রুটি বেলুনী দিয়ে মেয়েটার চোখে মুখে আঘাত করতে করতে ঘর থেকে বের করে দেন। মেয়েটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্নই বলছে এক পেট ভাতের দাম চুকোতে কি অবর্ণনীয় শারিরীক অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়েছে দিনের পর দিন।
লিখতে বসেছি মিরপুর ডি ও এইচ এস এ বসবাসরত লেঃ কর্নেল তসলিমের স্ত্রী'র দ্বারা নির্যাতনের শিকার সাবিনার কথা। রাস্তায় কান্নারত অবস্থায় দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজন তাকে পল্লবী থানায় নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় সাবিনা বাদী হয়ে পল্লবী থানায় গৃহকর্ত্রী আয়েশা লতিফের বিরুদ্ধে মামলা করে। শারীরিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানো হয়েছে। মামলাটির আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য মহিলা আইনজীবি সমিতির সাথে যোগাযোগ করেছি। আজ সকালে এডভোকেট সালমা আলী ওসিসিতে যান ভিক্টিমের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু ক্যন্টনমেন্ট বোর্ড় মেয়েটিকে তাদের জিম্মায় নিয়ে গেছে সকালেই।
এরপরের গল্প মনে হয় আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি। সব ম্যানেজ হয়ে যাওয়া দেশে সাবিনাও ম্যানেজ হয়ে যাবে। অথবা ভাল্লুক আসবে সেনা কর্মকর্তা আবাসন এলাকার কড়া নিরাপত্তা বলয়ে। শুধু ঠা ঠা পড়া মানুষের আকৃতি নিয়ে জম্বুর মতো দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের মতো কিছু মানুষ। আমাদের মাথার উপর একখন্ড অস্বচ্ছ আকাশ। যে আকাশের নীচে লেখা হবে জীবনের আপোষনামা ও জবানবন্দি।
যে জবানবন্দী আর আপোষনামার জোরে হ্যাপি ভুলে গিয়েছিলো শাহাদাত নামের এক পিশাচ ক্রিকেটার তাকে রুটি বেলোনি দিয়ে চোখের উপর মারতো। হ্যাপি ভুলে গেছে গায়ে গরম খুন্তি ছ্যাঁকা আর মার খেতে খেতে এক সন্ধ্যায় সে ঘর থেকে বের হয়ে কালসি বাজারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলো।
এরকম আপোষনামার গল্পে জান্নাতুল নামের এক কিশোরীও ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিল মানবতাবাদী শিল্পী 'কৃষ্ণকলি'র কাছে। গরম ভাত রাঁধেনি বলে বকুনি খেয়ে নাকি ফাঁসিতে ঝুলে 'আত্মহত্যা' হয়ে গিয়েছিল আমাদের জান্নাতুল। জান্নাতুলকে ধর্ষণ করেছিল কিনা, বা চেষ্টা করেছিল কিনা, আত্মহত্যা করার আগে জামাই বাবু অর্ককে কেন খামচি দিয়েছিলো তা আমরা জানবো না কখনো। কারণ এসব ভাসুরের গল্প আমাদের মিডিয়া লিখে না। আমরা শুধু জেনেছি, একটা আপোষনামার কথা। জান্নাতুল এর বোন সেই আপোষনামায় লিখেছিলো “আমার বোন মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না। ওকে মেরে ফেলার খবর জানলেও মামলা করব না। মামলা করলে তো বোনকে আর ফিরে পাব না”......
আরো আছে। ডাস্টবিনে পড়ে থাকা আদুরি, কাপ ভাঙার অপরাধে পিঠে গরম ইস্তিরির ছেঁকা খাওয়া রংপুরের ১২ বছরের রহিমা...কাঁচের প্লেট ভাঙার অপরাধে এসআইয়ের স্ত্রীর হাতে সারা শরীরে গরম খুন্তির ছেঁকা খাওয়া ১০ বছর বয়সী রোমেলা......আইনজীবীর বাসায় কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফেরা কিশোরগঞ্জের তাহমিনা...হিসু করার অভিযোগে টেবিলের নিচে মাথা দিয়ে বেদম পিটিয়ে আহত করে ৪ তলার রান্নাঘরের ব্যালকনি দিয়ে ফেলে দেয়া ৯ বছরের শিশু শারমিন.......
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ' (বিলস) এর তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে অন্তত ১৮২ জন নির্যাতিত গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ১৪৩ জন। দৃশ্যমান বিচারের গল্প নেই। আছে কেবল গরম খুন্তি, রুটি বেলুনি হত্যা, আত্মহত্যা, আর আপোষনামার গল্প। টাকার আকাশে উড়তে থাকে সার্ভেন্ট রুমের মেঝেতে পড়ে থাকা চাকরের জীবন। আহারে, জীবন!! যে জীবন 'ম্যানেজ' করা যায়, ম্যানেজ হয়ে যায়। যে জীবন দুলতে থাকে আপোষনামা আর টাকার বান্ডিলের মাঝখানে। আহা টাকা...একটা আপোষনামা...একটা রিক্সা ভ্যান...গরম ধোঁয়া উঠা মোটা ভাত...আর একটা জীবন!!
ব্যাস, আবেগের প্যানপ্যানানি বাদ। বন্ধুরা, পথে নামুন সবাই। এবার সাবিনার জন্য আওয়াজ তুলুন। কোনভাবেই যেনো অপরাধিরা আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে না যায়। সেনানিবাসের সুরক্ষিত এলাকায় সাবিনা যেনো তনুর মতো হারিয়ে না যায় তার জন্য রাজপথে থাকুন। আওয়াজ তুলুন ঘরে ঘরে গৃহকর্মে শিশু নিয়োগ দেওয়ার অপরাধের বিরুদ্ধে।
আমাদের মিলিত কন্ঠের হুঙ্কার যেন টাকার জোর ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় ক্ষমতার দাপটে জীবনকে তুচ্ছ করা ওই হারামীদের কানের পর্দায়। এত জোরে আওয়াজ তুলুন যেন মানুষের জীবন-মৃত্যুর আপোষনামা লিখার আগে দুঃস্বপ্নে কাপড় নষ্ট করে ওই দালালেরা।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ