জুনাইদ'দের বাড়ি ফেরা হয় না..!
প্রকাশ | ২৯ জুন ২০১৭, ২৩:০৪
পনেরো বছরের জুনাইদ বড় ভাইয়ের সাথে ঈদের বাজার করে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলো। সারাদিন রোজা ছিলো সে এবং কথা ছিলো কেনাকাটা সেরে বিকেলে মায়ের সাথে ইফতার করবে সবাই মিলে। কিন্তু তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কেন জানেন?? তার অপরাধ সে ভারতের মুসলমান। সংখ্যালঘু। আর যেহেতু সংখ্যাগুরুর দেশে সংখ্যালঘু মানেই গরুখেকো, পাকিস্তানের চর, দেশদ্রোহী। কোনো প্রমাণ, সাক্ষী লাগে না একথা প্রমাণ করতে। সংখ্যাগুরুরা এগুলোকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে চলেন। তো এই অপরাধে সেদিন চলন্ত ট্রেনে সহযাত্রীরা প্রথমে গো-হত্যা ও গোমাংস খাওয়ার জন্য তাদের গালাগালি করে। তারপর গণপিটুনি। শেষে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় জুনেইদের। তার সঙ্গী মইন ও মহসিন এবং বড়ভাই শাকির গুরুতর আহত হয়ে এখন হাসপাতালে। পুলিশও তার প্রাথমিক তদন্ত থেকে বলেছে ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকেই এই হামলা হয়েছে।
জুনেইদের সঙ্গী মহসিন এনডিটিভিকে বলেছে, তারা ট্রেনের চেন টেনেছিল, কিন্তু ট্রেন থামেনি। তারা রেল পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল, কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি।
এই ঘটনায় এ পর্যন্ত মাত্র একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রমেশ নামক ওই অভিযুক্ত বলেছে, সে নাকি মদ্যপ ছিলো। তার বন্ধুরা বলেছিল, ওরা গরুর মাংস খায়।
গ্রামের মানুষের অভিযোগ, ট্রেনে-বাসে যাতায়াতের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে প্রায়ই হেনস্তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এইসব খবর যখনই দেখি আমার প্রচণ্ড ভয় হয়! গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কীভাবে একজন মানুষকে মেরে ফেলা যেতে পারে!! একটি প্রাণী, যাকে কিনা কিছু মানুষ নিজেদের 'মা' মনে করে– তার প্রাণ কীভাবে একজন মানুষের প্রাণের থেকে মূল্যবান হয়ে যেতে পারে? আমার মৌলিক অধিকার কি করে কারোর ব্যক্তিগত মানসিকতা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতির লক্ষ্য হতে পারে?? আমি কী খাবো সেটা কি করে অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে?? যারা গরুকে দেবতুল্য সম্মান দেয়, তাদের ধর্মীয় অনুভুতির প্রতি যেরকম সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, ঠিক সেইভাবে অন্য ধর্মের মানুষ, যারা গরুকে দেবতা মনে করেন না, তাদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে সংবিধানে। তাহলে কোন ভিত্তিতে দেশের সাধারণ নিরীহ নাগরিকদের একের পর এক খুন হতে হচ্ছে?? গরু রক্ষার নামে রাষ্ট্রের নাগরিকদের খুন হতে হবে, এটা কোন ধরণের ধর্ম রক্ষা?? এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র??
ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটার মানে কী? রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবে না। কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাবে না। অথবা কাউকে আলাদা করে বিরোধিতা করবে না। নাগরিকদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ ধর্মাচরণের অধিকার থাকবে, কিন্তু তা কখনই অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। এটাই তো?? তাহলে প্রশ্ন জাগে ভারতীয় রাষ্ট্র কি এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ?
এপ্রিল-জুন, এই কমাসে প্রায় বারো জন মুসলিম মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়েছে গোমাংস খাওয়ার গুজব রটিয়ে। কি নৃশংস!! শুধুমাত্র মুসলিম হলেই পিটিয়ে মারা যায়? দলিত হলেই পিটিয়ে মারা যায়? এর আগেও বিজেপি শাসিত রাজস্থানের আলওয়ারে গো-রক্ষকদের গণপিটুনিতে মুহাম্মদ পহেলু খান নিহত হন। একইভাবে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে মুহাম্মদ আখলাককে গণপিটুনিতে হত্যা করে উগ্র ধর্মান্ধরা। সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে ও গোমাংস গুজবে এক পরিবারের উপর হামলা চালানো হয়। এবারেও এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল একেবারে দেশের রাজধানী দিল্লির নাকের ডগায়। অথচ কেন্দ্র অথবা হরিয়ানার বিজেপি সরকারের কোনো হেলদোল নেই!! নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাত্তাই দিচ্ছেন না!! এই নীরবতা কি জাতি-হত্যাকে প্রশ্রয় জোগাচ্ছে না?? মুখে ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া আর ভেতরে ভেতরে দেশজুড়ে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোই কি তার দলের গোপন এজেন্ডা??
সারা দেশ জুড়ে এক শ্রেণির বিকৃত উন্মাদ, মানুষ নামধারী কিছু জানোয়ার, মানুষ নিধন যজ্ঞে মেতেছে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চেহারায়। কোথাও গোরক্ষার নামে, কোথাও হিন্দুত্ব রক্ষার নামে। আমার ধর্ম তোমার ধর্ম থেকে ভালো। আমার ধর্ম সংখ্যাগুরুদের ধর্ম। অতএব তুমি সংখ্যালঘুকে আমার ধর্ম মেনে চলতে হবে। তোমাকে 'জয় শ্রী রাম' বলতে হবে, তোমাকেও গরুকে দেবতা জ্ঞানে পূজো করতে হবে। আমার ধর্মটাই মেনে চলতে হবে, আমার চিন্তাধারাই সাবস্ক্রাইব করতে হবে, নইলে শালা তোমায় ক্যালাবো, প্রকাশ্যে হিউমিলিয়েট করব, তোমাকে খুন করব, তোমার বাড়িতে ছেলে ঢুকিয়ে মেয়েদের রেপ করাবো। এই হলো দেশের একশ্রেণীর মানুষের ধারণা। আর তাদের পরোক্ষে, অনেকক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছে খোদ রাষ্ট্র। দলিত, সংখ্যালঘু, সেক্যুলার, মানবতাবাদীরা, সরকার, রাষ্ট্রের সমালোচনাকারীরা আক্রান্ত, অত্যাচারিত, পরাধীন, বিপন্ন। সারা দেশ জুড়ে তীব্র অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে। তাই দেশের এহেন পরিস্থিতিতে রাস্তা একটাই, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, রাস্তায় নেমে বুলেটের মুখে, ঝলকানো ছোরার সামনে।
#Not_In_My_Name
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট