সংস্কার ছাড়া সভ্য পৃথিবীতে স্থান পাওয়া সম্ভব নয়
প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০১৬, ০২:১৬ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬, ০৪:৩৩
সব ধর্মেই রিফরমেশন হয়েছে। সব ধর্মের নারী বিরোধী আর মানবাধিকারবিরোধী নিয়মকানুন গুলোর বদল হয়েছে। আইন করেই বদল করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও বদল হয়েছে অনেক, তবে আরও কিছুর বদল চাইছে মুসলিম দুনিয়ার অনেক মেয়ে। তারা লেখালেখি করছে এ নিয়ে। ভিন্ন মত প্রকাশ করছে। তারা বলছে তারা ইসলামকে এত ভালবাসে যে ঋতুস্রাবের কারনে তারা রোজা রাখা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চাইছে না। ঋতুস্রাবের সময় তারা রোজা তো রাখতেই চায়, নামাজও পড়তে চায় । যদিও তাদের অব্যহতি দেওয়া হয়েছে রোজা থেকে, কিন্তু মেয়েরা অব্যহতি পেতে চাইছে না। তারা এমনই ধর্মপ্রাণ যে তারা নামাজ রোজা ছাড়তে চাইছে না একদিনের জন্যও। তাছাড়া, রোজার সময় যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইসলামে , তা, তারা মনে করছে নিতান্তই পরিষ্কার থাকার জন্য। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা যদি নিজেরাই মেনে চলে, তাহলে নিষেধাজ্ঞা জারি করার তারা মনে করে না কোনো প্রয়োজন আছে। তারা বলছে, কোরানে কোথাও লেখা নেই মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় রোজা রাখতে পারবে না। কোরানে যেহেতু নেই, সেহেতু এই নিয়ম তারা মানবে না। যৌনসঙ্গম করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, তাও মেয়েরা মেনে নিতে চাইছে না। ইসলাম কখনো যৌনসঙ্গমকে অপবিত্র বলেনি, বিশেষ করে স্বামী ও স্ত্রীর যৌনসঙ্গম। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন রোজাকে আরও পবিত্র করবে বলেই তারা বিশ্বাস করে। সুতরাং রোজা রাখা অবস্থায় যৌনসঙ্গমের পক্ষে এই মুসলিম নারীরা রায় দিয়েছে। বমি করলেই বা রোজা ভেঙ্গে যাবে কেন, তাদের প্রশ্ন। বমি হওয়ার পর মুখ এবং মুখগহ্বর নিখুঁত ভাবে ধুয়ে নিলেই হয়।
মেয়েদের এসব দাবি শুনে অনেকে রাগ করতে পারেন, কিন্তু এ নতুন নয়। চিরকালই ভিন্ন কিছুর দাবি জানিয়েছে মানুষ, দাবি শুনে কিছু লোক রাগ করেছে, কিছু লোক চিন্তার খোরাক পেয়েছে। দাবির কিছুটা মানা হয়েছে, কিছুটা হয়নি। অনেক মুসলিম দেশেই তালাক তালাক তালাক বললেই আজকাল তালাক হয় না। অনেক মুসলিম দেশেই বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখার নিয়ম, কিন্তু উত্তর ইউরোপের দেশে শীতকাল এবং গরমকাল দু’কালেই সূর্যের ওঠা নামার ওপর নির্ভর করে রোজা রাখতে কোনো মুসলমানই স্বস্তি বোধ করেন না। শীতকালে থাকে দু’তিন ঘন্টা আলো , গরমকালে দু’তিন ঘন্টা অন্ধকার । উত্তরের দেশগুলোয় রমজান মাসে ঠিক কী করে চলতে হয়, তা নিয়ে ইসলাম কিছু বলেনি। সে কারণে ওখানকার মুসলমানরাই নিজেদের সুবিধে মতো রোজার সময়সূচি বানিয়ে নিয়েছে। এভাবেই সংস্কার চলে। আধুনিক সমাজে চলতে হলে সংস্কারটা খুবই জরুরি।
ইংল্যান্ডে একধরণের মসজিদ হয়েছে, ওতে মেয়েরা এবং সমকামীরাও ইমাম হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। মেয়ে-ইমামের পেছনে মেয়ে-পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। পুরোনো নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে অনেকে। সব ধর্মেই এই হয়। আধুনিক সমাজে ধর্মের যা কিছু বেমানান, তা ছেটে ফেলতে হয়। সবাই, বিশেষ করে যারা সচেতন, জানে, ইসলামের আরো সংস্কার দরকার। এই সংস্কার-কাজে এগিয়ে আসতে হবে প্রগতিশীল মুসলমানদের। এ যুগে আমরা মানবাধিকার আর নারীর সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি করি, এ যুগে গণতন্ত্রের গুণগান গাই, আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে নিশান ওড়াই। ধর্মকেও সমানাধিকারের আর মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে হবে। যত বেশি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে ধর্ম, তত বেশি টিকে থাকার সুযোগ পাবে।
ইসলাম ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বিভিন্ন সময়ে এর পরিবর্তন হয়েছে। মু’তাজিলার যুগ ছিল আলোকিত যুগ। সুফি ঐতিহ্য ইসলামের সবচেয়ে গৌরবের ঐতিহ্য। আলোর বিপরীতে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার। আরবের ইবনে আব্দুল ওয়াহাব সংস্কারের নামে গোটা ধর্মকে অন্ধকার গর্তে টেনে নিয়েছিলেন। আজকাল মৌলবাদ থেকে সন্ত্রাসবাদ জন্ম নিচ্ছে। যত সন্ত্রাস চলে বিশ্বে, তার বেশির ভাগ চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে। সারা বিশ্বে মুসলিম জিহাদির সংখ্যা শান্তিকামী মুসলিমদের চেয়ে কম হলেও জিহাদিরাই মুসলিমদের প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ মুসলিম বলতে অনেকেই আইসিস , বোকো হারাম, আল কায়দার লোকদের বোঝে। সাধারণ নিস্পাপ নিরীহ মুসলিমের ছবি ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে---এই লক্ষণ কিন্তু ভালো নয়। জিহাদি আদর্শের বিরুদ্ধে না লড়লে মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যত ঝরঝরে। জিহাদিদের শিকার মুসলমানরাই। জিহাদিরা যেভাবে প্রগতিশীল মুসলমানদের হত্যা করছে, এরকম চলতে থাকলে এক সময় মুসলমান বলতে জিহাদি এবং জিহাদি সমর্থকরাই অবশিষ্ট থাকবে। মুসলিম বিশ্বের প্রগতিশীলদের দায়িত্ব রাষ্ট্র থেকে, আইন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে পৃথক করা। এই সংশোধনী ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়। সংস্কার ছাড়া সভ্য পৃথিবীতে স্থান পাওয়া সম্ভব নয়, সম্মান অর্জন তো সম্ভবই নয়।
আমার ভালমানুষ মা যে কোরান পড়তেন, আইসিসের হত্যাকারীরাও একই কোরান পড়ে। আমার মা মানুষকে দয়া করতেন, আইসিসরা মানুষকে জবাই করে। কোরানের অনেক অংশকেই মা আক্ষরিক অর্থে নেন নি। কোথাও বুঝতে অসুবিধে হলে ভালো কোনো ব্যাখ্যা তৈরি করতেন। আইসিসরা তা করে না, তারা সপ্তম শতাব্দির ধর্মযোদ্ধাদের মতো। আমার মা’র মতো আধুনিক মনের মুসলমানের সংখ্যা প্রচুর হলেও তারা নেপথ্যে থাকে, সামনে আমরা যাদের দেখি, তারা সংখ্যালঘু সন্ত্রাসী মুসলমান।
নেপথ্যের মুসলমানরা নেপথ্যে থেকে গেলে জিহাদিরাই রাজত্ব করবে। সময় হয়েছে জিহাদিদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার। ইসলামকে শান্তির ধর্ম বানানোর। এই কাজটা কোনো সরকার করবে না। স্বার্থহীন সরকার পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে হবেও না। এই কাজটা তাই করতে হবে মুসলিম সমাজের সুস্থ সচেতন আধুনিক মানুষদের, যারা মানবাধিকারে, নারীর অধিকারে, সমকামীদের অধিকারে, রূপান্তরকামীদের অধিকারে, জীব-জন্তুর অধিকারে, সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে বিশ্বাস করে। যে যে কারণে মুসলিম তরুণ তরুণীরা জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই কারণগুলো খুঁজে বের করলেই সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব। কারণগুলো নির্মূল করলেই সমাধান হাতের মুঠোয়।
একেশ্বরবাদী ইহুদি, খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে অসহিষ্ণুতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন – কী নেই? যাদের ধর্ম, তাদের কিন্তু ও নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। ভুলে গেছে কোথায় কী আছে কী নেই। আইন তৈরি করে নিয়েছে সমানাধিকারের ভিত্তিতে, শিক্ষা করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে, সমাজ নির্মাণ করেছে ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে, রাষ্ট্র গড়েছে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে। আব্রাহামীয় ধর্মগুলো , সবচেয়ে ভাল হয় যদি একই পথে চলে, যদি ইসলামও সংস্কারের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দিতে মানবিক এক ধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলাদেশে ইসকনের হিন্দুরা তাদের মন্দির থেকে, বৌদ্ধরা তাদের উপাসনালয় থেকে দরিদ্র মুসলমানদের ইফতার বিতরণ করেছে। এই উদারতা আর মহানুভবতা মুসলমানরা কেন দেখাবে না! মুসলমানরা তাদের মসজিদে আশ্রয় দিতে পারে নিরাপত্তাহীন হিন্দুদের, মসজিদ থেকেই অন্ন যোগাতে পারে ক্ষুধার্থ বৌদ্ধদের, হাত বাড়াতে পারে সেই অমুসলিমদের দিকে যাদের ওই হাতটুকুর ভীষণ প্রয়োজন । মানুষ জানবে অমুসলমানদের কুপিয়ে মেরে ফেলা মুসলমানদের কাজ নয়, গ্রন্থে যা কিছুই লেখা থাক, গ্রন্থের বাইরে এসে মুসলমানরা মানবিক হতে পারে, মহান হতে পারে, নিরাপদ আর নিস্বার্থ হতে পারে।
ইসলামের সংস্কার তখনই সম্ভব হবে যখন মুসলমানরা নিজেদের সংস্কার করবে।
লেখক: নারীবাদী সাহিত্যিক